গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, হাজারো শহীদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশের যে সম্ভবনা তা আমরা সবাই মিলে বাস্তরূপায়ন করতে চাই। অনেকে বলছেন, আমাদের নতুন রাজনীতি দরকার, নতুন দেশ দরকার। কথা উঠছে, একটা নতুন রিপাকলিক করতে হবে।
একাত্তরে লাখো শহীদের রক্তে যে রাষ্ট্রের ঘোষণা হয়েছিল, সেখানে নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। ৫৩ বছরে এইটার কিছুই আমরা দেখিনি। সাম্য তো দূরের কথা, ন্যূনতম সুযোগের সমতা নাই। বহুদিক থেকে নানাভাবে বৈষম্য বিস্তৃত। নানা হিসেবে বলা হচ্ছে, গত ১৫ বছরে ১৮ লক্ষ-কোটি টাকা এইদেশ থেকে পাচার হয়েছে।
সংবিধান যে ক্ষমতার কাঠামো দিয়েছে, তাতে মসনদে যে বসে সেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। কারণ সমস্ত ক্ষমতা ওই একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। বহুবার এই কথা আমরা বলেছি। সংবিধান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এমন ক্ষমতা দিয়েছে যার কোনো জবাবদিহিদা নেই, বরং তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে। জনগণের প্রতিনিধি সরকার জনগণের অধীন থাকবে সেই ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।
আগামী দিনে নতুন যে রিপাবলিক হবে সেটি হতে হবে গণতান্ত্রিক রিপাবলিক; গণতান্ত্রিক একটি নাগরিকতন্ত্র, জনতন্ত্র কায়েম করতে হবে। ছাত্র, তরুণ, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ যারা রক্ত দিয়ে অভ্যুত্থান করেছেন এইটা তাদের রায়। সুতরাং এর বাইরে কেউ যেতে পারবেন না। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
শুক্রবার (৪ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জেলা গণসংহতি আন্দোলন আয়োজিত উম্মুক্ত সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় তিনি আরও বলেন, পুলিশের লাঠিচার্জ, মামলা, গ্রেপ্তার আমাদের নেতা-কর্মীরাও ভোগ করেছেন। বিএনপির লাখো নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, তারা বাড়িতে ঘুমাতে পারে নাই। সরকার রাষ্ট্রের একটামাত্র অঙ্গ। আরও অঙ্গ হচ্ছে- সংসদ, বিচারবিভাগ এবং এখন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে মিডিয়া বা গণমাধ্যম। এই সবগুলো অঙ্গের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। এই কারণে আমরা বলেছি, দুইবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় শাসন না, স্থানীয় সরকার। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ যেন বিচারবিভাগে না থাকে। সরকার গঠন ও বাজেট থাকা সমস্ত ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে দুই কক্ষের সংসদ করতে হবে।
জোনায়েদ সাকি বলেন, আবু সাঈদ বুকের রক্ত দিয়ে ভয়ের রাজত্ব ভেঙে দিয়েছে। আগামীর বাংলাদেশে ভয়ের রাজত্ব থাকতে পারবে না। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থান সফল হয়েছে কারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এই ঐক্য ভেঙে দিলে আবারও কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এখনই ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। এইটা না চাইলে জনগণের ঐক্য লাগবে। গণমানুষের স্বার্থের রাজনৈতিক শক্তি লাগবে।
আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ বলে আসছি, বিদ্যমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ফ্যাসিস্ট। এই বন্দোবস্ত ঘৃণা ছড়ায়। আমাদের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত লাগবে। আমাদের লাখো ছাত্র-তরুণরা এইদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারও তাই বলছেন।
নাগরিকের ধর্ম কী সেইটা রাষ্ট্র দেখবে না। রাষ্ট্র দেখবে সে রাষ্ট্রের নাগরিক। এইদেশে মন্দিরে হামলা হবে কার লাভ? ফ্যাসিস্ট শক্তির লাভ হবে, যাদের পতন ঘটেছে। তারা বলবে, এই দ্যাখে হিন্দুরা বাংলাদেশে কত অনিরাপদ। ভারতের মিডিয়া সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশকে জঙ্গীরাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করবে। কিংবা পাহাড়ে যারা হামলা করে তারা ফ্যাসিস্টের দোসর। সম্প্রীতি ছাড়া বাংলাদেশকে রক্ষা করা যাবে না।
গণঅভ্যুত্থানে নারীদের অংশগ্রহণের কথা তুলে ধরেন তিনি বলেন, এইদেশে ধর্ম, জাতি বা লিঙ্গীয় পরিচয় দিয়ে কাউকে তার অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আপনার মত প্রচার করতে পারেন কিন্তু জবরদস্তি করতে আপনি পারেন না। এই বন্দোবস্তে পৌঁছাতে না পারলে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।
আওয়ামী লীগের যারা মাঠে এসে মানুষের উপর গুলি করেছে তাদের বিচার করতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কাউকে নিপীড়ন করা যাবে না। রাজনৈতিক চিন্তা, আদর্শের পার্থক্য আদর্শ দিয়ে মোকাবেলা করেন। এইটার নামই গণতন্ত্র।
বাংলাদেশে আমরা দেখছি, সরকার যে ভূমিকা রাখছেন তার মোটাদাগের গতিমুখকে আমরা সমর্থন করি। তারা আশু পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চেষ্টা করছেন, দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার, পরিবর্তন, রূপান্তর, নতুন বন্দোবস্ত; তার জন্য সংস্কার কমিশনসহ অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু জনগণ আপনাদের কাছে আরও কার্যকর পদক্ষেপ চায়।
দেশের প্রশাসন এখনো পতিত ফ্যাসিবাদীদের দখলে। দেশের আইনশৃঙ্খলা-পুলিশ কাজ করছে না, কেন করছে না, কারা এর পেছনে দায়ি তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেন। জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নিয়ে কাজ করবে না, তা কোনোভাবে গ্রহণ করা যাবে না।
তিনি বলেন, পোশাক শ্রমিকদের অনেক ন্যায্য দাবি রয়েছে। তাদের ন্যায্য দাবি সমর্থন করি। কিন্তু গার্মেন্টসখাত দীর্ঘদিন বন্ধ রাখলে এই খাত টিকবে না। কারখানা চালু রেখেই দাবির পক্ষে লড়াই করবেন। কারও ষড়যন্ত্র সফল হতে দেওয়া যাবে না। একইসাথে লড়াই ও সতর্কতা থাকবে আমাদের।
গণসংহতি আন্দোলনের জেলা কমিটির সমন্বয়কারী তরিকুল সুজনের সভাপতিত্বে এই সময় আরও বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি, ইসলামী আন্দোলনের মহানগরের সভাপতি মাসুম বিল্লাহ, জেএসডির মোতালেব মাস্টার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মাহমুদ হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক ফারহানা মানিক মুনা, গণসংহতির জেলা কমিটির নির্বাহী সমন্বয়কারী অঞ্জন দাস, মহানগরের সমন্বয়কারী নিয়ামুর রশীদ বিপ্লব, কবি আরিফ বুলবুল প্রমুখ।