বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের বাম হাত হিসেবে পরিচিত মহানগর ছাত্রলীগ নেতা হাবিবুর রহমান রিয়াদ ওরফে রিয়াদ প্রধান এতদিন বিএনপি নেতাদের শেল্টারে লুকিয়ে ছিলো। তবে ৩ অক্টোবর বিএনপি নেতাদের সিগন্যালে ভারতে পালিয়ে গেছে সে। আর তার লুকিয়ে থাকা ও ভারতে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ওই নেতারা মোটা অংকের টাকা নিয়েছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এদিকে রিয়াদ পালানোর দুই দিন আগে অয়ন ওসমানের ডান হাত রাফেল প্রধানের সাথে মালয়েশিয়ার একটি ভিডিও প্রচার হয়। যা কৌশল বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানায়, নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদের আত্মীয়স্বজন অধিকাংশ বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। রিয়াদের চাচা গিয়াসউদ্দিন প্রধান জেলা মৎসজীবি দলের সাবেক সভাপতি, আরেক চাচা জসিমউদ্দিন প্রধান এনায়েতনগর ইউনিয়ন শ্রমিকদল ও ৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। ৭নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মিজান প্রধান এবং জেলা যুবদলের নেতা মশিউর রহমান রনিও রিয়াদ প্রধানের আত্মীয়।
তবে ঠিক কারা এতদিন রিয়াদকে লুকিয়ে রেখে কৌশলে মালয়েশিয়ার ছবি প্রচার করে ইন্ডিয়ায় পাঠানোর বিষয়ে সহযোগীতা করেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সূত্র জানায়, ৩ অক্টোবরের আগে হঠাৎ করে রিয়াদ ও রাফেলের মালয়েশিয়ার পুরনো ছবি প্রচার করে। প্রশাসনের দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য এ কায়দা করে পরে রিয়াদকে ভারতে যেতে সহায়তা করে। সূত্র আরও জানায়, অয়ন ওসমানের বাম হাত হয়ে রিয়াদ প্রধান অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। জালকুঁড়ি ও বন্দরে জায়গা কেনা আছে তার। মাসদাইরের বাড়িতেও আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার জায়গা কিনেছে। অয়ন ওসমানের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রন, ঝুট সহ চাঁদাবাজি করে টাকা কামিয়েছে সে। রিয়াদের সব সম্পদের হিসাব রয়েছে তার বাবা জালাল প্রধানের কাছে।
তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থীদের অনেকেই জানান, দীর্ঘ অনেক বছর তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদকে চর্চার সেল হিসেবে ব্যবসার করেছে রিয়াদ বাহিনী। মাদক সেবন থেকে শুরু করে সব ধরনের অপকর্ম করেছে সেখানে বসে। গভীররাত পর্যন্ত চলতো আড্ডাবাজি। রিয়াদ বাহিনীর টর্চ্চারের শিকার হয়েছে উঠতি বয়সের দুই সাংবাদিক ছাড়াও প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাকর্মী। রিয়াদ বাহিনীর কারণে কলেজ ক্যাম্পাসে কোন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন গত ১৫ বছর রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারেনি।
হাবিবুর রহমান রিয়াদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই রাতে সরকারি তোলারাম কলেজের সামনের সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ছাত্রদলের ৪ নেতাকর্মীকে পেটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে ছবি ও ভিডিও ধারণে বাধা দিয়ে দুই সাংবাদিককে মারধর করেন তারা। তাদের মোবাইলফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে সরকারি তোলারাম কলেজে ফরম পূরণ করতে গিয়ে রিয়াদ ও তার লোকজনের মারধরের শিকার হন ওই কলেজের দুই শিক্ষার্থী আতা-ই-রাব্বি ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। তারা দুজন ওই কলেজ শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন।
ওই সময় জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি ও সরকারি তোলারাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র আতা-ই-রাব্বি বলেছিল, 'আমি সেদিন তোলারাম কলেজে পরীক্ষার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম। তখন কলেজের ভেতরেই হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তার অনুসারী লোকজন আমাকে ও আরেক ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করে। এর আগেও ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি আমাকে হুমকি-ধমকি দিয়েছিল। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে থানায় গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয় বলে আইনি প্রক্রিয়ায় যাইনি। আর তোলারাম কলেজের ছাত্রছাত্রী সংসদের রুমটিকে তো টর্চারসেল বানিয়ে রাখা হয়েছে।'
২০১৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে কলেজের সামনের সড়কে আরেক শিক্ষার্থী শাহজাহান আলীকে পেটায় রিয়াদের নেতৃত্বে তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তোলারাম কলেজে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে সংবাদ করার জেরে সাংবাদিকের ওপর দুই বার হামলার অভিযোগও আছে। এ ঘটনায় সাংবাদিক সৌরভ হোসেন সিয়াম ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।
শুধু সাধারণ শিক্ষার্থী, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকদের পিটিয়েই মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি আলোচিত নন, ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
২০২১ সালের ১১ নভেম্বর সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউপির একটি ভোটকেন্দ্র দখলে গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হন হাবিবুর রহমান রিয়াদ। ভোটকেন্দ্রের সামনে বিশৃঙ্খলা করতে থাকা রিয়াদ ও তার দলবলকে বেধড়ক পিটিয়েছে র্যাব। পরে তাদের কাছ থেকে ককটেল, ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটাও উদ্ধার করে র্যাব। মার খেয়ে তখন নেতার কাছে কাঁদতে কাঁদতে রিয়াদ গংরা বলেন, আমাদের কুকুরের মতো পিটিয়েছে র্যাব। যদিও এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান নিতে পারেনি ছাত্রলীগ বা আওয়ামীলীগ। বরং এই ঘটনায় র্যাব নারায়ণগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে প্রসংশিত হয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করা হলেও, ছাত্রলীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রিয়াদ।
২০২৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে শহরের চাষাঢ়ায় আল-আমিন ওরফে দানিয়েলকে (২৮) কুপিয়ে হত্যা করে মরদেহ মাসদাইরে তার বাড়ির সামনে ফেলে রাখা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরাও হাবিবুর রহমান রিয়াদের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত।
প্রতিটি ঘটনায় স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রিয়াদের নাম এলেও, প্রভাবশালীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকার কারণে রিয়াদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়ার সাহস কেউ করে না বলে অভিযোগ আছে।