১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী আজ।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে। এবার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে নারায়ণগঞ্জে সরকারি পর্যায়ে ও আওয়ামী লীগের দলীয়ভাবে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন, নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন, জেলা পরিষদ, নারায়ণগঞ্জ জেলা, মহানগর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে এ উপলক্ষে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি রয়েছে। ফলে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি পালিত হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সকাল ৯টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুস্পস্তবক অর্পণ করা হবে।
পরে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও আলোচনা সভা আয়োজিত হবে। এছাড়া রয়েছে আরও বিভিন্ন আয়োজন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন (নাসিক) সূত্রে জানা যায়, ১৫ আগস্ট সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে নগর ভবন, মেয়র ভবন, কদমরসুল, সিদ্ধিরগঞ্জ আঞ্চলিক কার্যালয়ে ও ৩টি নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত অবস্থায় রাখা হবে। সকাল সাড়ে ৯টায় দুই নম্বর রেলগেট সংলগ্ন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ। এছাড়াও আরও বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সকাল বেলা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হবে। পরে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এবিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই জানান, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদাৎ বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সকাল জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করণ, দলীয় পতাকা অর্ধনমিত করণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ প্রচার।
সকাল ১০টায় শহরের দুই নং রেলগেইটস্থ জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পন করা হবে। পরে আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল।
তিনি আরও বলেন, ১৫ আগস্ট আমাদের জেলা আওয়ামীলীগের দিনব্যাপী কর্মসূচি রয়েছে। আমাদের প্রতিটি থানা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠন গুলো পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হবে। আমরা সেখানে অংশগ্রহণ করবো।
এবিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের এড. খোকন সাহা জানান, জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট উপলক্ষে ২৭টি ওয়ার্ডে আমাদের দিনব্যাপী কর্মসূচির মধ্যে আলোচনা সভা, মিলাদ মাহফিল ও কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে সকাল ৯টায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ।
এরপর সভাপতি ও আমি পৃথকভাবে ২৭টি ওয়ার্ডের অনুষ্ঠান গুলোতে অংশগ্রহণ করবো। আর ১৮ আগস্ট মহানগর আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
মূলত, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারী ইতিহাস রচিত হতে থাকে।
সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।
দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় 'সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।
একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।'
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে।
পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।
১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে ৮বার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
অন্যদিকে, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন। কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।
পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।
দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।
২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হয় খুনি মাজেদ।