ছবিতে উপরে ডানদিকে বাবা শফিকুল ইসলাম, বামে টেনশন গ্রুপ প্রধান সীমান্ত। নিচে গ্রেপ্তারকৃত ৭জন একদিনের রিমান্ডে
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি হাতে এক তরুণের একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। জানা যায়, ভিডিওতে অস্ত্র ও গুলি হাতে থাকা ওই তরুণের নাম রাইসুল ইসলাম সীমান্ত।
সে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি প্রার্থী শফিকুল ইসলামের বড় ছেলে এবং সিদ্ধিরগঞ্জের ২নম্বর ওয়ার্ডে সক্রিয় কিশোর গ্যাং 'টেনশন গ্রুপে'র প্রধান। বাবা শফিকুল ইসলামের শেল্টারে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সীমান্ত।
এমন অভিযোগ এলাকাবাসীর। গত বছর সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকায় ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে এই টেনশন বাহিনী।
এই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ২নম্বর ওয়ার্ডে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগে গত ৬ আগস্ট সীমান্তসহ ৭ জনকে ছোরা, সুইচ গিয়ার, লোহা, স্টিলের পাইপসহ গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তারা কারাগারে।
ফেসবুকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ সীমান্তের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় এলাকাবাসী তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার কাছ থেকে অস্ত্রটি উদ্ধারের দাবি জানিয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, 'টেনশন গ্রুপে'র প্রধান সীমান্ত পিস্তল ও গুলি নিয়ে গানের সঙ্গে নাচানাচি করছে। একপর্যায়ে খালি রিভলবার বন্ধু রুবেলের দিকে তাক করে তাকে ডেকে তার দিকে ব্লাঙ্ক ফায়ার করছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তারা কয়েকজন মিলে এক যুবককে শাসাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিদ্ধিরগঞ্জের ২ নম্বর ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দা জানান, সীমান্তের টেনশন গ্রুপের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এলাকার সাধারণ মানুষ। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা তাদের বখাটেপনা থেকে রক্ষা পায় না। প্রতিবাদ করলে পরিবারের ওপর নানা ঝামেলা আসে। হুমকি-ধমকি দিয়ে ভয়ভীতি দেখানো হয়। ফলে কেউ আইনের আশ্রয় নিতে সাহস করে না।
এলাকাবাসী জানান, প্রচণ্ড শব্দ করে বাইকের হর্ন বাজিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে চলাচল করা তাদের অভ্যাস। মোটরসাইকেল নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় চলে তাদের মহড়া।
এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা অর্ধশতাধিক। অস্ত্র, মাদক তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ভিডিওতে যে টর্চার সেল দেখা গেছে, সেখানে বিভিন্ন তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করে টাকা-পয়সা, মোবাইল রেখে দেয় তারা। নির্যাতনের শিকার কেউ ভয়ে মুখ খোলেন না।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এরা অপ্রতিরোধ্য, পাড়া-মহল্লায় দল বেঁধে অবাধে চলাফেরা করে। এমন কোনো অপরাধ নাই যা তারা করে না। বয়স দেখলে বুঝার কোনো উপায় নেই এদের অপরাধ কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। এরা যেকোনো তুচ্ছ ঘটনায় চড়াও হচ্ছে যে কারো ওপর। অনেকের কাছে এরা এখন মূর্তিমান আতঙ্ক।
এদের শাসন করতে গিয়ে এলাকার সম্মানিত মানুষও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। পুলিশের খাতায় তালিকা না থাকায় কিংবা বয়স কম হওয়ায় এরা গ্রেফতারের বাইরে থেকে যায়। অভিযোগ রয়েছে, বীরদর্পে তাদের অপকর্ম চলমান থাকলেও স্থানীয় প্রশাসন উদাসীন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মূলত নিন্মবিত্ত পরিবারের বখে যাওয়া সন্তানদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গ্যাং। আবার বড় লোকের ধনির দুলালও আছে। রয়েছে প্রভাবশালীদের বখে যাওয়া কিশোর সন্তান।
তবে নিজের ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে শফিকুল বলেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ভিডিওটি এডিট করে তাঁর ছেলেকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। তিনি আরও দাবি করেন, তাঁর ছেলে ভারতের দার্জিলিং থেকে এসএসসি পাস করেছে। বর্তমানে সেখানেই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা করছে। ৩ মাস আগে ছুটিতে বাড়িতে আসে সে।
এলাকাবাসী জানায়, গত বছরের এপ্রিল মাসে মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায় বাধা দেয়ায় মিজমিজি দক্ষিনপাড়া এলাকায় টেনশন বাহিনী হামলায় আহত হয়, দেলোয়ার হোসেন দোলন (২৫), আল-আমীন (২১) ও রিপন (২৩)।
এই ঘটনায় আহত দেলোয়ার হোসেন দোলন বাদী হয়ে সীমান্তসহ ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করেন। এক পর্যায়ে ওই বছরের ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ৭টার দিকে কিশোরগ্যাং সন্ত্রাসী ও টেনশন বাহিনীর প্রধান সীমান্তের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা মামলা তুলে নিতে দেলোয়ারকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার এসআই মোখলেসুর রহমান জানান, সীমান্তসহ গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে। এ সপ্তাহেই তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে।
থানার ওসি (তদন্ত) হাফিজুর রহমান মানিক বলেন, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া অস্ত্র চালানোর ভিডিওটি তাঁরা হাতে পেয়েছেন। খুব শিগগিরই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করবেন। র্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, কিশোর গ্যাং দমনে তাঁদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। র্যাবও এই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা করবে।
এদিকে রোববার (১৪ আগস্ট) সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃত টেনশন বাহিনীর প্রধান সীমান্তসহ ৭ জনকে এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। অবৈধ অস্ত্রের বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।