ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ও নিকলী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোকাররম সরদার (৪৮) কে ফতুল্লার আলীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।
গ্রেপ্তারকৃত মোকাররম সর্দার কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী থানার দামপাড়ার মৃত নুরুল ইসলামের পুত্র।
সোমবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শরীফুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, গভীর রাতে সেনাবাহিনী মোকাররমকে ফতুল্লা থানায় সোপর্দ করছে।
তাকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে।
এর আগে চলতি মাসের ২ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় চাঁদা দাবি ও মারধরের ঘটনায় সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ ও মোকাররমসহ ১১ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। এ মামলায় আরও পাঁচজনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালতে শাহ আলম নামের এক ব্যবসায়ী বাদী হয়ে মামলার আবেদন করলে আদালতের নির্দেশে ফতুল্লা থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্যবসায়িক কাজে যাওয়ার সময় পিস্তল ঠেকিয়ে বাদীর সঙ্গে থাকা নগদ ২০ লাখ টাকাসহ জরুরি কাগজপত্র ছিনিয়ে নেন অভিযুক্তরা।
এ সময় তারা তাকে অপহরণ করে আলীগঞ্জে মোকাররমের অফিসে নিয়ে যান। এ সময় তাকে মারধর করে ১০টি অলিখিত চেকের পাতা ও স্ট্যাম্পে সই নিয়ে নেওয়া হয়।
জানাগেছে, মোকাররম সর্দারের বাবা নূরুল ইসলাম জীবন জীবিজার তাগিদে ৯০ দশকের দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার আলীগঞ্জ এলাকায় আসেন। সেখানে তিনি বড় ছেলে মোকাররমকে সাথে নিয়ে তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন।
এক সময় শ্রমিক লীগ নেত কাউছার আহম্মেদ পলাশের হাত ধরা লোড-আনলোড শ্রমিক হিসেবে নাম লেখান মোকাররম। এরপর লোড-আনলোডের শ্রমিকদের সর্দার হন তিনি।
তার নাম মোকাররম হোসেন হলেও লোড-আনলোডের শ্রমিকদের সর্দার হিসেবে কাজ করায় তিনি মোকাররম সর্দার নামেই সব জায়গায় পরিচিত। লোড-আনলোডের সামান্য শ্রমিক থেকে আজ তিনি অঢেল সম্পদের মালিক।
ওয়ান-ইলেভেনের সময় কয়েকটি কোম্পানি জাহাজের মালামাল রেখে চলে যায়। ফতুল্লার প্রভাবশালী শ্রমিকলীগ নেতা কাউছার আহম্মেদ পলাশের সহযোগিতায় চাঁদাবাজিসহ জাহাজের মালামাল লুট করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হন মোকাররম।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে হারুন নারায়ণগঞ্জের এসপি হয়ে সেখানে গেলে মোকাররম সর্দার তার আশীর্বাদ লাভ করেন। মোকাররম সর্দারের মাধ্যমে হারুন পাথর ও কয়লার ব্যবসার পাশাপাশি জাহাজের পণ্য চোরাইয়ের সিণ্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেন। এসব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হন হারুন।
এছাড়া জাহাজের পণ্য চোরাইয়ের সিণ্ডিকেটও নিয়ন্ত্রণ করেন। এসবের মাধ্যমে হারুন অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন।
হারুনের অন্তত হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ও সম্পদের জিম্মাদার হিসেবে রয়েছেন মোকাররম সর্দার। হারুনের টাকাতেই ভারতীয় কয়লা আমদানি থেকে শুরু করে, সার, কয়লা, ইট, পাথর ও বালুসহ শত শত কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছেন মোকাররম সর্দার।
ডিবি হারুনের ছোট ভাই ডা. এবিএম শাহরিয়ার রাজধানীর মিরপুরে একটি হাসপাতাল পরিচালনা করেন। হাসপাতালটি হারুনের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এর বড় অংশীদার মোকাররম সর্দার। নারায়ণগঞ্জের আলীগঞ্জে অন্তত ১০টি প্লট কিনেছেন মোকাররম সর্দার। এর মধ্যে ৪টি বিলাসবহুল অট্টালিকা করেছেন। এসব বাড়িকে অনেকেই এসপির বাড়ি নামে চিনেন।
গত ২১শে মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ডিবি হারুন কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশকে ব্যবহার করে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে তাকে জিতিয়ে আনেন। নির্বাচনের সময় সেটি ছিল ওপেন সিক্রেট। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরপরই তিনি ঢাকায় গিয়ে হারুনের সঙ্গে ফুলেল শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
মোকাররম সর্দারের মাধ্যমেই হারুনের টাকায় কিশোরগঞ্জের নিকলীতে অত্যাধুনিক অটো রাইস মিল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উপজেলার কারপাশা ইউনিয়নের নানশ্রী গ্রামে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সড়ক সংলগ্ন এলাকায় অটো রাইস মিলটি তৈরি করা হয়েছে।
ডিএমপি’র তেজগাঁও জোনের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ২০২১ সালের ২২শে জানুয়ারি নির্মাণাধীন মিলটি হেলিকপ্টারযোগে পরিদর্শনে যান হারুন। দুই একর জায়গার উপর তৈরি করা জেলার সর্ববৃহৎ এ অটো রাইস মিলটি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়নি। দৈনিক ১০০ টন ধান মিলটিতে প্রক্রিয়াজাত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
তবে মোকাররম সর্দার নিকলী অগ্রণী ব্যাংক থেকে সিসি লোন নিয়ে অটো রাইস মিলটি করেছেন বলে দাবি করেলেও স্থানীয়রা বলছেন ৫০ কোটি টাকার মিলটিতে ব্যাংক ঋণের বিষয়টি লোক দেখানো।
এদিকে কেবল অটো রাইস মিল নয় কিশোরগঞ্জ সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় মোকাররম সর্দারের মাধ্যমে নামে-বেনামে অন্তত ৭টি ইটভাটা ও বিপুল পরিমাণ জায়গাজমি রয়েছে হারুনের। এর বাইরে জেলার বিভিন্ন ইটভাটায় কয়লা সরবরাহের অন্তত শত কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে।
মোকাররম কিশোরগঞ্জ শহরের বিন্নগাঁও এলাকায় হারুনের টাকায় ৮২.৪৩ শতাংশ জায়গার দুটি প্লট কিনেছেন। এর বাইরে জেলা শহরের উকিলপাড়া এলাকায় হারুনের একটি তিনতলা বাসা রয়েছে। মিঠামইনের ঘাগড়া ইউনিয়নের নিজ গ্রাম হোসেনপুরে গড়ে তুলেছে শতকোটি টাকার অভিজাত ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’।
এছাড়া রিসোর্ট সংলগ্ন এলাকার হাওরে অন্তত ১০০ একর জায়গা দখলে নিয়ে সেখানে একটি এগ্রো প্রজেক্ট গড়ে তোলারও পরিকল্পনা করেছিলেন হারুন।
সম্প্রতি মোকাররম সর্দারের মাধ্যমে হারুনের উপর একটি সিনেমা বানানোর প্রজেক্ট হাতে নেয়া হয়েছিলো। সিনেমাটির নাম দেয়া হয়েছিলো ‘হাওরের মানিক’। সেখানে পুলিশ অফিসার হারুনকে হাওরের মানিক হিসেবে চিত্রায়িত করার কথা ছিলো।