নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

রোববার,

০৬ অক্টোবর ২০২৪

সিদ্ধিরগঞ্জে সব কিছুতেই ছিলেন সেই ‘জালাল মামা’

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:২০:৪৫, ৫ অক্টোবর ২০২৪

সিদ্ধিরগঞ্জে সব কিছুতেই ছিলেন সেই ‘জালাল মামা’

হাজী জালাল উদ্দিন। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল টেকপাড়াস্থ জেএমএস গ্লাস ফ্যাক্টরীর মালিক। তবে সবার কাছে তিনি ‘জালাল মামা’ হিসেবে পরিচিত। সিদ্ধিরগঞ্জে স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে তার প্রভাব ছিল ভয়ঙ্কর। সিদ্ধিরগঞ্জে আওয়ামীলীগের সকল অনুষ্ঠানে তার সরব উপস্থিত ছিল চোখে লাগার মতো। এমনকি সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার দরজায় কড়া নাড়তো সব সময়। নেক নজর পেতে নিয়মিত তারা হাজিয়া দিতেন তার ব্যক্তিগত অফিসে। দিয়ে আসতে অবৈধ আয়ের একটি অংশ মানে নজরানা। কেউ কোন মাসে ঠিক মত নজরানা না দিলেই তার সমস্যা তৈরী হতো। শুধু আওয়ামলীগ নয়, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছেও তিনি পছন্দের জালাল মামা ছিলেন। কিন্তু কে এই রহস্যজনক চরিত্রের জালাল মামা? এই নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার কমতি ছিল না। সবাই মাঝে কিভাবে তিনি জালাল উদ্দিন থেকে জালাল মামা হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়াও ভয়ে কেউ তার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেনি।  


স্থানীয় এলাকাবাসী ও বিভিন্ন তথ্যমতে, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের প্রভাবশালী সাবেক এমপি শামীম ওসমানের মামা শ্বশুর হচ্ছেন জালাল উদ্দিন। সেই সুবাদে শামীম ওসমান অনুসারী নেতাকর্মীদের কাছে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন জালাল উদ্দিন থেকে ‘জালাল মামা’ হিসেবে। তবে সেটা ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর। ওই নির্বাচনে প্রথমবারের মতো শামীম ওসমান এমপি নির্বাচিত হলে জালাল মামার পোয়া বারো হয়ে উঠে পুরো সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায়। ওই সময়ে প্রভাবশালী ‘মামা’ বনে যান তিনি সিদ্বিরগঞ্জ এলাকায়। শামীম ওসমান এমপি হওয়ার আগে জালাল উদ্দিন ‘জালাল মামা’ খেতাবটা তার শরীরে তেমন একটা লাগেনি। 


স্থানীয়রা জানায়, ৯০ দশকে আদমজীর সালেহা সুপার মার্কেট নির্মান করার মধ্য দিয়ে আদমজী সোনামিয়া বাজার এলাকার মানুষে কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন বেশি। আর শিমরাইল টেকপাড়া এলাকায় জেএমএস গ্লাস ফ্যাক্টরীর সুবাদে ওই এলাকায় একজন ব্যবসায়ি হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। কিন্তু শামীম ওসমান এমপি হওয়ার পর একধাপ এগিয়ে যান জালাল মামা। ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে অবৈধ আয়ের নেশা পেয়ে বসে তাকে। জায়গা-জমির সমস্যা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা, স্থানীয় রাজনীতির সমস্যা, মহল্লা ভিত্তিক এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়ে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে সমস্যা, জবর-দখল সব কিছুতে নাক গলিয়েছেন জালাল মামা। শামীম ওসমানের অনুসারী আওয়ামীলীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা তাকে খুশি রেখেই চলতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ মামা যদি ঘোস্যা করেন তাহলে শামীম ওসমানের বিরাগভাজন হওয়ার ভয় থেকেই নেতাকর্মীরা জালাল মামাকে সমীহ করতেন। শত হলেও শামীম ওসমানের বৌয়ের দিকের আত্মীয় ছিলেন জালাল মামা। 


জালাল মামার যতগুন!
বিভিন্ন সূত্রমতে, শামীম ওসমানের মামা শ্বশুর হওয়ার কারণে জালাল মামা সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় আওয়ামীলীগের নেতাদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ সময় নুর হোসনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন জালাল মামা। নুর হোসেনও জালাল মামাকে সমীহ করতেন শামীম ওসমানের মামা শ্বশুর হওয়ার কারণে। আলোচিত সাতখুনের পর নুর হোসেন ও তার বাহিনীর সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর নুর হোসেনের এফ প্রিমিয়াম (ঢাকা মেট্রো-২৯-৮৮-৬২)  নামে মাইক্রোবাসটি জালাল মামার গ্লাস ফ্যাক্টরীর ভেতর থেকে উদ্ধার করে আইনশৃংখলা বাহিনী। এলাকায় আলোচনা আছে, নুর হোসেনের পতনে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছেন জালাল মামা। রীতিমত স্বঘোষিত ‘ডন’ বনে গিয়েছিলেন তিনি। ফলে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে সহযোগি সংগঠনের সকল নেতারাই জালাল মামার দ্বারস্থ হয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জে ঘটন-অঘটন সবই জালাল মামার নলেজে থাকতে হবে। কারণ সব কিছু থেকে তার হিস্যা (ভাগ) চাই।

মজার বিষয় হলো, বিভিন্নভাবে নানা কৌশলে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জবাসীকে বুঝিয়ে দিতেন তিনিই সিদ্ধিরগঞ্জে ‘কর্তা’। শামীম ওসমানের পরেই তার অবস্থান। তিনি যা বলবেন তাই হবে। এতে করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও শামীম ওসমানের অনুসারী আওয়ামীলীগ সমর্থিত নাসিক কাউন্সিলরদের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন তিনি। তাদেরকে তার নিয়ন্ত্রনে থাকতে বাধ্য করেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, মাদক ব্যবসায়ি ও পরিবহন চাঁদাবাজ ভাগিনা দেলোয়ার ও নুর হোসেরনের ছোট ভাই বালু সন্ত্রাসী জজ মিয়াকে সরাসরি শেল্টার দিয়েছেন জালাল মামা। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিতেন মাসে মাসে।

এছাড়াও কারাবন্দি ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামী নুর হোসেনের মেসেজে তার ভাই মিয়া মোহাম্মদ নুরুউদ্দিনকে বিএনপি থেকে আওয়ামীলীগে ভিড়িয়েছেন জালাল মামা। এছাড়া শিমরাইলের নাজমুলের কাছ থেকেও সুবিধা নিয়েছেন নিয়মিত। আবার চোরাই তেল ব্যবসা থেকে সুবিধা নিতে সাবেক কাউন্সিলর সিরাজ মন্ডলকে শামীম ওসমানের কাছে ভিড়িয়ে দেন জালাল মামা। জালাল মামার কারণেই নাসিক ৬নং ওয়ার্ডের পরিবেশ অশান্ত ছিল আওয়ামী সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত। এই ওয়ার্ডটিকে জালাল মামা নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রন করেছেন। আর সুবিধা নিয়েছেন। এসব কথা ওই ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।


সূত্রমতে, সিদ্ধিরগঞ্জের বাইরেও ফতুল্লার বিভিন্ন এলাকায়ও জালাল মামার নিয়ন্ত্রন ছিল। এনায়েত নগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান নিয়মিত জালাল মামার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তাকে দুই দফা চেয়ারম্যান বানাতে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে জালাল মামা। এমন কথা স্থানীয় আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মুখে মুখে ছিল। 


মোটকথা সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমানের অবর্তমানে স্বঘোষিত ‘কর্তা’ বনে গিয়েছিলেন জালাল মামা। যদিও প্রকাশ্যে শামীম ওসমানের সামনে জালাল মামার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস করতেন না। মজার বিষয় হলো সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমানের কোন অনুষ্ঠানে জালাল মামাকে খুব একটা দেখা না গেলেও শামীম ওসমানের সহধর্মীনি লিপি ওসমানের সকল প্রোগ্রামে জালার মামার সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে শামীম ওসমানের অনুসারী নেতাকর্মীরা সব কিছুতে জালাল মামার অযাচিত হস্তক্ষেপ ও সুবিধাভোগি কর্মকান্ড বন্ধে এমপি শামীম ওসমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে কেউ জালাল মামার অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেনি।


ওই সময় সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামীলীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছিলেন, গোপনে তদন্ত করলে জালাল মামার অনেক কিছু জানা যাবে। যা প্রকাশ্যে অনেকেই জানে না। সিদ্ধিরগঞ্জে সব কিছুর সাথেই ছিল জালাল মামার নাম। স্থানীয় আওয়ামীলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, বালু ও পাথর ব্যবসা থেকে সুবিধা, পরিবহনের চাঁদাবাজির সুবিধাসহ অনেক কিছুর সাথে জড়িত ছিলেন জালাল মামা। কোরবানীর ঈদে নাসিকের ৫নং ওয়ার্ডে গরুর হাটেও মামার কতৃত্ব ছিল। হাটের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় পোস্টারে তার নাম ছিল।
৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ও শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছে জালাল মামা। 

সম্পর্কিত বিষয়: