বামে শফিকুল, ডানে সারিব, সীমান্ত ও সিমন
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজিতে আলোচিত তিনটি কিশোরগ্যাং গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপ তিনটি হলো-টেনশন গ্রুপ, ডেবিল এক্সো গ্রুপ ও মাফিয়া গ্রুপ। এরমধ্যে আলোচিত হচ্ছে টেনশন গ্রুপ। এই গ্রুপের লিডার হচ্ছে উঠতি বয়সী দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী রাইসুল ইসলাম সীমান্ত।
এছাড়া ডেভিল এক্সো গ্রুপের লিডার সাকিবুল ইসলাম সারিব ও মাফিয়া গ্রুপের লিডার তাহসিন ইসলাম সিমন। মজার বিষয় হলো এই তিন কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী গ্রুপের লিডাররা মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকার শফিকুল ইসলামের তিন ছেলে।
শফিকুল ইসলাম সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। বতর্মানে স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে বেড়ান। যদিও তার কোন পদ পদবী নেই স্বেচ্ছাসেবকলীগে।
এলাকায় আধিপত্য ও নিজের অবস্থান মজবুত রাখতে তিন ছেলেকে দিয়ে তিনটি কিশোর গ্যাং বাহিনী গড়ে তুলেছেন শফিকুল ইসলাম। কখনো কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলে অর্থের যোগান দিয়ে শফিকুল ইসলাম তাদের জামিনে বের করে আনেন। এবং ক্ষমতাসীন দলে শীর্ষ নেতাদের পাশে দাড়িয়ে ছবি তুলে শফিকুল ইসলাম এলাকায় নিজেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেন।
কিন্তু শফিকুল ইসলাম ও তার ছেলেদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে বিরক্ত সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামীলীগ ও সহযোগি সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। তারা বলেন, কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের তৎপরতায় এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ।
ইভটিজিং, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মাদক বিক্রি ও মাদক সেবনসহ এমন কোন অপকর্ম নাই যা এই এই কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীরা করে না।
এছাড়া তাদের বখাটেপনার কারণে এলাকার স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা নিরাপদে রাস্তায় চলাচল করতে ভয় পায়। কিশোরগ্যাং সন্ত্রাসীরা প্রায় সময় হোন্ডা মহড়া দেয় এলাকার পাড়া মহল্লায়।
এলাকাবাসী জানায়, সেভেন মার্ডারের ঘটনায় নিহত নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্যালক হচ্ছে শফিকুল ইসলাম।
নজরুল ইসলামের জীবনদশায় শফিকুল ইসলাম ও তার বাবা মরহুম শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ও তার ফাঁসি দাবি করে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবং শহিদুল ইসলাম র্যাব, পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছিল।
অথচ নজরুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর সবচেয়ে সুবিধাভোগী হয় শহিদুল ইসলাম ও শফিকুল ইসলাম। ওই সময় শফিকুল ইসলাম নানাভাবে চেষ্টা করে নজরুল ইসলামের শুন্যস্থান দখল করার জন্য। কিন্তু নজরুল ইসলামের সমর্থকরা শফিকুল ইসলামকে কোনভাবেই মেনে নেয়নি।
তাদের অভিযোগ ছিল, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে শফিকুল ইসলাম। তার সাথে আমরা কেন যাবো। তখন ভিন্ন পথে হাটে শফিকুল ইসলাম। এক পর্যায়ে নিজের বখাটে ছেলে সীমান্তকে দিয়ে ৪-৫ বছর আগে গড়ে তোলে কিশোর গ্যাং বাহিনী। নাম দেয় ‘টেনশন গ্রুপ’।
ধীরে ধীরে বখাটে ও উঠতি বয়সী সন্ত্রাসীদের টেনশন গ্রুপে ভিড়ায় সীমান্ত। কিশোর গ্যাং বাহিনীকে অর্থ দিয়ে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করে শফিকুল ইসলাম। শুরু হয় এলাকায় কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসীদের ত্রাস।
এদিকে টেনশন গ্রুপের কিছুদিনের মাথায় শফিকের ছোট ছেলে তাহসিন ইসলাম সীমনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'মাফিয়া গ্রুপ'। এই মাফিয়া গ্রুপ আলোচনায় আসার জন্য এলাকায় প্রচুর বিশৃঙ্খলা করে।
এক পর্যায়ে নাসিকের ১ ও ২ নং ওয়ার্ডের মিজমিজি পশ্চিম পাড়া, মিজমিজি দক্ষিণ পাড়া, মিজমিজি কালু হাজী, ধনু হাজী, পাইনাদী নতুন মহল্লাসহ আশেপাশের এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে 'টেনশন গ্রুপ' ও 'মাফিয়া গ্রুপ'।
সীমান্তের নেতৃত্বে টেনশন গ্রুপের সদস্যরা হচ্ছে-সীমান্তের অন্যতম সহযোগী মঈন, সৌরভ, আবির, শাওন, মাইনুদ্দিন ও শয়নসহ অনেকে। অন্যদিকে সীমনের নেতৃত্বে মাফিয়া গ্রুপের সদস্যরা হচ্ছে- সিমনের অন্যতম সহযোগী ও আলমগীরের ছেলে বিজয়, ইরফাদ, আল-আমীন, শাওন, জয়, রাকিব, জীবন, খাইরুল, সাব্বির ও ফাহিমসহ অনেকে।
এই দুই গ্রুপের বেশিরভাগ সদস্যদেরই নিজস্ব মোটরসাইকেল রয়েছে যা দিয়ে তারা এলাকায় নানা অপকর্ম করে থাকে।
টেনশন গ্রুপের প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে ২০২১ সালের ২২ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজি দক্ষিণপাড়া ক্যানেল পাড় এলাকায়। টেনশন গ্রুপের অতর্কিত হামলায় জখম হয় তিন যুবক। আহতরা হলোÑ দোলন, আল আমিন ও রিপন।
এদের মধ্যে দোলন গুরুতর আহত হয়। সন্ত্রাসীরা চারটি মোটরসাইকেল যোগে এসে এই হামলা চালায়। যার নেতৃত্বে দেয় টেনশন গ্রুপের লিডার রাইসুল ইসলাম সীমান্ত। ঘটনার সময় এলাকাবাসী কিশোর গ্যাংয়ের তিন সন্ত্রাসীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।
হামলার ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের লিডার সীমান্তকে প্রধান আসামি করে ১৩ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরো সাত-আটজনকে আসামি করে আহত দোলন বাদি হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করে। মামলার বাদি আহত দোলনের অভিযোগ ছিল-প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে মারধর করে হত্যার চেষ্টা চালায় সন্ত্রাসী সীমান্ত বাহিনী।
ওই সময় এলাকাবাসী জানায়, মিজমিজির সন্ত্রাসী শফিকুল ইসলাম সফির ছেলে রাইসুল ইসলাম সীমান্ত টেনশন গ্রুপ নামে একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ গড়ে তুলেছে। এই কিশোর গ্যাংটি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এই হামলার ঘটনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় টেনশন গ্রুপের একের পর এক হামলা।
২০২২ সালের ৬ আগস্ট রাতে সিদ্ধিরগঞ্জের ২নং ওয়ার্ডের মিজমিজি এলাকা থেকে টেনশন গ্রুপের প্রধান সীমান্তসহ ওই গ্রুপের ৭ কিশোর সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। বাকীরা হলো-নজরুল মিয়ার ছেলে মো. নাঈম মিয়া, আল আমিনের ছেলে মো. হাসান, মো. ইসলামের ছেলে মো. পারভেজ মিয়া, আব্দুল হাকিমের ছেলে আবির বিন হাকিম, আমান উল্লাহের ছেলে মো. রাহাত, নুরুল ইসলামের ছেলে মো. রিয়াদুল ইসলাম।
গ্রেপ্তারের পর তাদেরকে তল্লাশি করে একটি ছোরা, দুটি সুইচ গিয়ার চাকু, দুটি ছোরা এবং দুটি লোহা ও স্টিলের পাইপ উদ্ধার করলেও কোনো পিস্তল উদ্ধার করা হয়। পরদিন র্যাব-১১ সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করে তাদের বিরুদ্ধে।
১২ আগস্ট সকালে টেনশন গ্রুপের চর্চার সেলে অস্ত্রবাজি, মাদক সেবন ও এক কিশোরকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্ধর্ষ কিশোর গ্যাং সন্ত্রাসী ‘টেনশন গ্রুপ’ এর টর্চার সেলে অস্ত্র চালানো ও মাদকের অ্যাকশনের ভিডিও খণ্ড খণ্ড কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, টেনশন গ্রুপ প্রধান রাইসুল ইসলাম সীমান্ত পিস্তল ও গুলি নিয়ে গানের সঙ্গে নাচানাচি করছেন। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, তারা কয়েকজন মিলে এক যুবককে নির্যাতন করছেন।
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল সকালে হিরোইন ও ইয়াবাসহ কিশোর গ্যাং টেনশন গ্রুপের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা হলো-গিয়াসউদ্দিন টুলুর ছেলে মঈন ও একই এলাকার বাসিন্দা মাদক সম্রাজ্যি রহিমার ছেলে শুভ।
এদিকে টেনশন ও মাফিয়া গ্রুপের অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যে শফিকুলের আরেক ছেলে সাকিবুল ইসলাম সারিব গড়ে তুলে ‘ডেবিল এক্সো গ্রুপ। শুরু হয় তিন কিশোরগ্যাং বাহিনীর রামরাজত্ব।
২০২৩ সালের ৩১ আগস্ট এবং ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর মিজমিজি এলাকায় মধ্যরাতে টেনশন গ্রুপের নেতা সীমান্ত ও তার বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন বসতবাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। ২৪ মার্চ রাতে মিজমিজি দক্ষিনপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে “টেনশন গ্রুপ” ও “ডেভিল এক্সো গ্রুপ”র দুই কিশোর গ্যাং বাহিনীর ১৭ সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-১১।
তারা হলো-রাইসুল ইসলাম সীমান্ত (২২), সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকার মো: তাজুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম (২৬), সানারপাড় এলাকার আ: রহমানের ছেলে মোঃ হুমায়ুন হোসেন (২৪), মিজমিজি কান্দাপাড়া এলাকার মো: আমিন উদ্দিনের ছেলে মোঃ সাজ্জাদ হোসেন (২৬), নারায়ণগঞ্জের বন্ধরের লাঙ্গলবন্দ এলাকার খোকন শেখের ছেলে মো: রাব্বি (২৫), সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকার মনিরুল ইসলামের ছেলে প্রিতম রোবায়েতি ইসফাক (২৯), ডেবিল এক্সো গ্রুপের লিডার সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি এলাকার শফিকুল ইসলাম শফিকের ছেলে মোঃ সারিব (১৯), একই এলাকার হারুনের ছেলে মোঃ আশিক (১৯), দেলোয়ার হোসেনের ছেলে মোঃ নাঈম (১৯), আজাদ শিকদারের ছেলে মোঃ তুহিন হোসেন (১৮), খন্দকার মোহাম্মদ নুরুল্লাহর ছেলে রোসমান (১৯), বাক্কির ছেলে মোঃ শাহাদৎ (১৯), তাজুল ইসলামের ছেলে মোঃ সৌরভ (২০), নুর নবীর ছেলে মোঃ মাহিন (২০), ইমান আলীর ছেলে মোঃ তুষার (২০), নবীর হোসেনের ছেলে মোঃ সৌরভ (১৯), আনোয়ার হোসেনের ছেলে মোঃ আরিফ (১৯)। বেশ কিছুদিন কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে ফের শুরু করে অপকর্ম।
এর ধারাবাহিকতায় ২১ মে রাতে সাদমান চৌধুরী (২১) নামে এক যুবককে মারধর করে তার আই ফোন-৭, গলার স্বর্ণের চেইন, আংটি ছিনিয়ে নেয় টেনশন গ্রুপের প্রধান রাইসুল ইসলাম সীমান্ত ও তার লোকজন।
এখানেই শেষ নয়, পরে সাদমানের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ ঘটনায় সীমান্তসহ দুইজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০ জনকে আসামী করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সন্ধ্যায় টেনশন গ্রুপের অন্যতম সদস্য মো. রাহাত হোসেন (২৪) মিজমিজি দক্ষিণপাড়ায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে রিয়াদুল ইসলাম (২৯) নামে এক যুবকের মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। এসময় ওই যুবক বাধা দিলে তাকে বেধড়ক মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে।
একপর্যায়ে হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী রাহাত তার হাতে থাকে ছুরি দিয়ে ওই যুবককে আঘাত করেলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপরও ক্ষ্যান্ত হয়নি রাহাত। লুটিয়ে পড়া যুবকের উপর চড়াও হয়ে এস এস পাইপ দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে। পরে স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসী রাহান দৌড়ে পালিয়ে যায়।
এলাকাবাসীর জানান, তিন কিশোরগ্যাং বাহিনী ‘টেনশন গ্রুপ, মাফিয়া গ্রুপ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপ’ কে পরিচালনা করেছেন শফিকুল ইসলাম। আমরা অবিলম্বে এই কিশোরগ্যাং বাহিনী থেকে মুক্তি চাই। শফিকুল ইসলাম তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিলজ্জভাবে ছেলেদের সন্ত্রাসী কাজে নামিয়েছে।
এমন পিতা সমাজের জন্য কলঙ্ক। সন্তানের জন্যও অভিশাপ। আইনশংখলাবাহিনীর কঠোর তৎপরতা থাকলেও হয়তো শফিকুল ইসলাম বেশিদিন তার সন্ত্রাসী বাহিনী টিকিয়ে রাখতে পারবে না। এমনটা বলছেন সচেতন মহল।
আরও পড়ুন:সিদ্ধিরগঞ্জে কিশোরগ্যাং টেনশন ও ডেভিল এক্সো গ্রুপের শেল্টারদাতা শফিকুলের বিরুদ্ধে জিডি