ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতুর পশ্চিম পাড় থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার এলাকায় জেলা ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন তদারকিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন মহাসড়ক দিয়ে চলমান যানবাহনের মালিক, চালক ও শ্রমিকরা।
দীর্ঘ দিন থেকে মাসিক মাসোহারা, টোকেন বাণিজ্য আর চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রন নিতে হাইওয়ে পুলিশকে উপেক্ষা করে জেলা ট্রাফিক পুলিশ বেপোয়ারা হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করছে যানবাহনের মালিক, চালক ও শ্রমিকরা।
তারা বলছেন একই জায়গায় জেলা ও হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করায় মানষিকভাবে তাদের ধাক্কাধক্কিতে সড়কে শৃংখলার পরিবর্তে মানুষের ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে দূর্ঘটনা। গত দুই মাসে মহাসড়কে ছিনতাইকারীদের অপ্রতিরোধ্য কর্মকান্ডে অনেকেই সর্বশান্ত হলেও কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
তবে এবিষয়ে জেলা ট্রাফিক পুলিশ বলছে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাড়ি রিকুইজিশন করা হচ্ছে। যেসকল গাড়ির কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে হাইওয়ে ট্রাফিক পুলিশ বলছে আমরা আমাদের নির্ধারিত এলাকায় যথানিয়মে দায়িত্ব পালন করছি। জেলা ট্রাফিক পুলিশের মহাসড়কে কর্মকান্ড নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারছিনা। তবে মহাসড়কে তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে যদি আমাদের সাথে সমন্বয় করে তাহলে কাজ করতে অনেক সুবিধা হবে।
অপরদিকে পরিবহন মালিক, চালক, শ্রমিক ও নেতৃবৃন্দরা বলছেন, মহাসড়কে হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে। নিয়মিত চেক পোস্ট, তল্লাশি ও বিভিন্ন সড়ক আইনে মামলা দিয়ে আসছেন। এসব মামলা মোকদ্দমা নিয়ে পরিবহন ব্যবসা করে পুঁজি হারানোর অবস্থা। পথে বসে যেতে হচ্ছে।
এরই মধ্যে সম্প্রতি মহাসড়কের সাইনবোর্ড, সানারপাড়, মৌচাক, শিমরাইল মোড়, কাঁচপুর সেতুর নীচেসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্টাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির মহোৎসবে মেতে উঠেছে। এসব পয়েন্টে জেলা ট্টাফিক পুলিশের বিভিন্ন কর্মকর্তারা যানবাহনে তল্লাসির নামে মোটা অংকের চাঁদা তুলছেন।
কোন কোন সময়ে পরিবহনের ফিটনেস নেই, চালকের লাইসেন্স নেই, গাড়ির রোড পারমিট নেই বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বাস ট্টাক, সিএনজিসহ বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা আদায় করছেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ওই পরিবহনকে জরিমানা করা হচ্ছে।
পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে পনের হাজার পর্যন্ত টাকা জরিমানার করছেন ওই জেলা ট্টাফিক পুলিশের কর্মকর্তারা। আর উৎকোচ বা মুচলেকা দিলেই সবকিছু সমাধান হয়ে যাচ্ছে। গত দুই মাস ধরে এমনই পরিবহন চাঁদাবাজির কার্যক্রম চালাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্টাফিক বিভাগ।
এই মহাসড়কের তিন কিলোমিটারে জেলা ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের ভিন্ন ভিন্ন তদারকিতে তাদের গুনতে হচ্ছে লোকসান। পুলিশের সোর্সরা প্রস্তাব দিচ্ছেন নিয়মিত মাসোহারা দিতে। মাসোহারা না দিলে এরকম চলবেই।
তারা আরও বলেন, এভাবে খুব বেশিদিন চলতে দেওয়া যাবেনা । আমাদের রুটি রোজগারে এভাবে অবৈধ ও অন্যায়ভাবে আঘাত হানতে থাকলে আমরা প্রয়োজনে আন্দোলন সংগ্রাম করবো।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মহাসড়কে গতম দুই মাস ধরে নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের এই চাঁদাবাজি নিত্যদিনের হয়ে দাড়িয়েছে। যানজটের তোয়াক্কা না করে শুধু দিনে নয়, রাতভর চাঁদা নিতে তৎপর এসব ট্রাফিক সদস্যরা।
প্রতিটি ট্রাক থেকে ন্যূনতম ১০০ থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা বা তারও বেশি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। রাতের বেলায় কাঁচপুর সেতু হয়ে গাড়ি শিমড়াইল মোড়ে ঢুকলেই তাদের টাকা দিতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টক (টিআই) আব্দুল করিম শেখের নির্দেশে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড ও শিমরাইল মোড়ের বিভিন্ন পয়েন্টে সার্জেন্ট সোহেল ও তার সহযোগী জিয়া নামের একব্যক্তি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি বিভিন্ন যানবাহন দেখা ও তল্লাসির নামে বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদাবাজি করছেন।
দাবিকৃত চাঁদা না দিলে গাড়ি ডাম্পিং এ দিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। তারপরও যদি চাঁদার মাশোয়ারা না দেয় তাহলে গাড়িটি মামলা দিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
এভাবেই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সাইনবোড থেকে শিমরাইল মোড় ও কাঁচপুর সেতুর নীচের বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা তুলছেন।
চালকদের অভিযোগ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্টরা যত্রতত্র যানবাহন থামিয়ে কাগজপত্র চেক করার নামে চাঁদা আদায় করছেন।
শুধু তাই নয়, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশা এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন নানা ব্রান্ডের গাড়ি কারণে-অকারণে থামিয়ে কাগজপত্র চেকসহ বিভিন্ন অজুহাতে হয়রানি করছে।
আবার অনেক গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটক রাখায় যানজটেরও সৃষ্টি হচ্ছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করা নয়, সাধারণ মানুষকে হয়রানি আর টাকা আদায়ই তাদের মূল টার্গেট।
শান্তি পরিবহনের চালক ইব্রাহিম জানান, তার ঢাকা মেট্রো-ব ১৪-১৯৩৭ নাম্বারের গাড়িটি নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের সার্জেন্ট ফয়সাল গাড়িটি আটক করে পনের হাজার টাকার মামলা করে দেয়।
গাড়িতে ৪১টি সিটের পরিবর্তে ৩৭টি সিট থাকার অপরাধে এই মামলা করা হয়। তিনি বলেন, সামান্য অপরাধে কিভাবে আমাদের পনের হাজার টাকা মামলা দেওয়া হয়েছে তা কোনভাবেই বুঝে উঠতে পারছিনা।
ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৯১৪৩ সময় পরিবহনের চালক রায়হান মিয়া জানান, তার গাড়িটি মহাসড়কের এক পাশে^ ছিলো হঠাৎ জেলা পুলিশের সার্জেন্ট সোহেল রানা ও তার সঙ্গীয় ফোর্স জামাল মিয়া গাড়িটি জব্দ করে পাঁচ হাজার টাকা মামলা দিয়ে দেন। কি অপরাধে মামলা দেওয়া হয়েছে তা কোনভাবেই বুঝতে পারছি না।
তিনি বলেন, ঢাকা মেট্রো-ব, ১১-৩৪২১, ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৮৯৩১, ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৮৩৮৭ এই পরিবহনগুলো আটক করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় জেলা ট্রাফিক পুলিশ।
তারাবো মেঘলা হিমাচল শ্রাবন পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম মিয়া জানান, কাগজপত্র ও চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক থাকার পরেও অহেতুক হয়রানি করে চালকদের কাছ থেকে মামলা দেওয়ার নামে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন জেলা ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। আমরা এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সময় পরিবহনের চেয়ারম্যান সৈকত হোসেন জানান, গত দুই মাস যাবৎ নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা সাইনবোর্ড, শিমরাইল, সানারপাড় ও মৌচাক মোড়ে আমাদের পরিবহনগুলো থেকে যেভাবে চাঁদা আদায় করছে এই অবস্থা করছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা ছেড়ে দিয়ে অন্য ব্যবসা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) আব্দুল করিম শেখ জানান, যদি কোন জেলা ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে কাঁচপুর হাইওয়ে থানার শিমরাইল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ টিআই সরফুদ্দিনের মোবাইলে ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ট্রাফিক রুহুল আমিন সাগর জানান, উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গাড়ি রিকোজিশন করা হচ্ছে। যেসকল গাড়ির কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে।
ট্রাফিক পুলিশের উৎকোচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ওই সকল সার্জেন্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
গাজিপুর রিজিয়ন এর হাইওয়ে পুলিশের পুলিশ সুপার সীমা রানি সরকার জানান, জেলা ট্রাফিক পুলিশের কাজ হলো আঞ্চলিক সড়কগুলো দেখভাল করার। আর হাইওয়ে পুলিশের কাজ হলো মহাসড়কগুলো দেখাশুনা করবে। তবে হাইওয়ে পুলিশ ও জেলা পুলিশ সমন্বয় করে কাজ করলে সুন্দর হয়।