নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চনপাড়া বস্তির অঘোষিত সম্রাট বজলুর রহমান ওরফে বজলু মেম্বারের অপরাধ সা¤্রাজ্যের ২৩ কর্তা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই ২৩ জনের মাধ্যমে বজলু তার সকল অপরাধ পরিচালনা করে। বজলুর ইশারায় চলে চনপাড়া বস্তির মাদক কারবারসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-। বস্তির ১১৪টি মাদক স্পটের একক নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন তিনি, যেখান থেকে মাসে প্রায় ২৩ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এসকল তথ্য দিয়েছেন চনপাড়ার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা।
বজলুর বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চনপাড়া বস্তির ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার নাদের বক্সের ছেলে তিনি। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অন্তত ২৩টি মামলা ছাড়াও পুলিশ ও র্যাবের ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে। বজলুর গ্রামের বাড়ি বরিশালের হিজলা উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চলের দুর্গাপুরে। নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে পরিবার-পরিজনসহ বজলুর বাবা চনপাড়া বস্তিতে চলে আসেন। তখন তার বয়স ছিল ৫। একসময় নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে বেড়ে ওঠা বজলু এখন কোটি টাকার মালিক। এর নেপথ্যে রয়েছে মাদক কারবার, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণ আদায়, প্লট জবরদখলসহ অপরাধমূলক কর্মকা-। সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে পরপর দুবার কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার হয়েছেন। ইউপি সদস্য হলেও তার আছে তিনজন গানম্যান, দুজন ব্যক্তিগত সহকারী।
বস্তির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে বস্তিতে বজলুর উত্থান হলেও মূলত ২০০৪ সাল থেকে আলোচনায় আসেন তিনি। ওই সময়ে মাদক কারবার আর ভাড়াটে মাস্তান হিসেবে কাজ করতেন। একপর্যায়ে কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া) মেম্বার হওয়ার পর তার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রূপগঞ্জের তৎকালীন সংসদ সদস্য সফিউল্লাহর বিরুদ্ধে ঝাড়ু মিছিল করে রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষের আস্থাভাজন হয়ে যান বজলু। এরপর থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মদদে বস্তিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি টুন্ডা বজলু নামে পরিচিতি পান।
সূত্র জানায়, বজলু এতটাই শক্তিশালী যে, স্থানীয় থানা পুলিশের অনেক সদস্যই তাকে সমীহ করে চলতেন। মাথার ওপর অনেক মামলা ঝুললেও থানার ওপেন হাউজ ডে’তেও তার সরব উপস্থিতি ছিল। বজলুর বাবা এক সময়ে বস্তির গুদারাঘাট এলাকায় নৌকা চালাতেন। ১০ বছর আগেও একটি চালের দোকানের মালিক ছিলেন এই বজলু। এর আগে ছিঁচকে চোর থেকে বাসের হেলপারও ছিলেন। মলম পার্টির সদস্য হিসেবে নাম ছিল তার। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ২০ বছরে চনপাড়া বস্তিতে খুন হয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ১৫ জন। গত দেড় যুগে শুধু চনপাড়া এলাকার মাদক কারবারসংক্রান্ত ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় হওয়া মামলার সংখ্যা দুই হাজারের ওপর।
বজলু তার আত্মীয়স্বজনদের নিজের অপকর্মে ব্যবহার করেন। বজলুর অপকর্মের সহযোগীদের অন্যতম জয়নাল, শমসের, স্বপন, নাজমা, বজলুর ভাই বোতল মিজু, সাদ্দাম হোসেন স্বপন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, ইউসুফ, সায়েম, নাজমা, রিপন, শাওন, রেহান মিয়া, জাকির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, শাহীন, হাসান, রাজা, রুমা ও শ্যালক জাকিরসহ অন্যরা চনপাড়াকে অপরাধের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে।
আরও পুড়ন :রুপগঞ্জের চনপাড়ার ৪২ মাদক ব্যবসায়ি অধরা
প্রসঙ্গত: আলোচিত মেম্বার বজলুর রহমান (৪২)কে শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) বিকালে র্যাব গ্রেপ্তার করে। র্যাব-১-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন জানিয়েছেন, ‘র্যাবের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে বজলুকে। তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত হওয়া ২৩টি মামলার তথ্য আমরা পেয়েছি। তবে কতগুলো মামলা চালু আছে এবং কোনটা কীসের মামলা তা এখনো জানতে পারিনি।’ বজলু কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের চনপাড়া ইউনিটের (চনপাড়া শেখ রাসেল নগর ইউনিয়ন) সাধারণ সম্পাদকও।
র্যাব জানিয়েছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া বস্তি এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গেলে র্যাবের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় রূপগঞ্জ থানায় মামলা করা হয়। মামলার এজাহারে বজলুসহ ৩১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয়ের আরও ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে গত ১০ নভেম্বর রাতে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ চনপাড়া বস্তির আরেক সন্ত্রাসী সিটি শাহীন নিহত হয়। সিটি শাহীনের সব অপকর্মের প্রশ্রয়দাতা বজলু রহমান এমন দাবি র্যাবের। এ ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যাকা-ে চনপাড়া বস্তিকেন্দ্রিক অপরাধীদের নাম আসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে। এরপর থেকেই বিভিন্ন গণ্যমাধ্যমে চনপাড়ার বস্তির অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রকদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে।