নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

বৃহস্পতিবার,

০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রাণের বিনিময়ে দেশের মানুষ রক্ষা  করবে জাতীয় পতাকার সম্মান

কামাল উদ্দিন সুমন

প্রকাশিত:১৭:১৮, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রাণের বিনিময়ে দেশের মানুষ রক্ষা  করবে জাতীয় পতাকার সম্মান

৫২,৬৯,৭১, আর ২০২৪। দেশপ্রেম,জাতীয় পতাকার সম্মান,মাতৃভুমির নিরাপত্তা। কোনটাতেই পিছিয়ে ছিলনা বাংলাদেশের মানুষ। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার প্রচেষ্টা ৫২ সালে ভুন্ডুল করে দিয়েছে এদেশের মানুষ। ৬৯‘র গনঅভূত্থ্যান,৭১‘র স্বাধীনতা যুদ্ধ আর ২৪ সালে ফ্যাসিবাদের বিদায় সবই করেছে এদেশে মানুষ। এসবই দেখেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। কিন্তু তাদের হুঁশ হয়নি। বরং বছরে পর বছর নিজেদের আধিপত্যবাদ ছাপিয়ে দিয়ে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। 


বিশেষ করে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে, শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে ভারত নজিরবিহীন প্রভাব বিস্তার করে শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, মিডিয়া ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি ছদ্ম-ঔপনিবেশিক আধিপত্য সৃষ্টি করে। ৫ আগষ্ট ফ্যাসিবাদের বিদায়ের পর হতাশায় নিমজ্জিত হয় প্রতিবেশী দেশ ভারত। পতিত স্বৈরা”ারকে আশ্রয় দিয়ে নানা ধারনে কলকাঠি নাড়তে থাকে । তাদের কলকাঠি নাড়া শুধু শেষ হয়নি। রূপ নিয়েছে হিংসায়। গত ২ ডিসেম্বর একটি চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে আক্রমণ করে জাতীয় পতাকায় অগ্নিসংযোগ করেছে।


উগ্রপন্থী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সহযোগী সংগঠন সংগ্রাম সমিতি বাংলাদেশে হিন্দুবিরোধী সহিংসতার মিথ্যা দাবি এবং ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে কমিশনের চত্বরে বিক্ষোভ ও সম্পত্তি ভাঙচুর করে। এই নির্লজ্জ কাজ শুধু কূটনৈতিক প্রোটোকলের লঙ্ঘনই নয়, একই সাথে এটি শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনারও প্রকাশ । হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশে ভারতের সযত্নে নির্মিত অধিপত্যের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। দিল্লি তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।


শেখ হাসিনার বিদায়ের পর থেকে ভারত বাংলাদেশে তার প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় অন্তবর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার বহুমুখী কৌশল নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাকৃত মিডিয়ার মাধ্যমে আক্রমণাত্মক প্রচার-প্রচারণা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মিথ্যা বর্ণনা এবং প্রবল কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি। আগরতলা হাইকমিশনে হামলার ঘটনা ভারতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ক্রমবর্ধমানভাবে বাংলাদেশ বিরোধীদের সাথে সারিবদ্ধ হওয়ার একটি সংকেত। 


বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় মিডিয়া ও বিনোদনের বিস্তার এমন একটি সূক্ষ্ম উদ্যোগ ছিল যা সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারে হয় কার্যকর হাতিয়ার। ভারতীয় টেলিভিশন, সিনেমা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো বাংলাদেশে সর্বব্যাপী প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এসব স্থানীয় জনমতকে প্রভাবিত করে এবং ভারতের নমনীয় ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশে ভারতীয় অনুদানপ্রাপ্ত মিডিয়া চ্যানেলগুলো ভিন্নমতের কণ্ঠ পাশ কাটিয়ে হাসিনাপন্থী আখ্যান ছড়িয়ে দেয়।


দেশে ইসলামিক চরমপন্থার বর্ণনা, চীনা প্রভাব এবং ভারতবিরোধী মনোভাব ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশকে দিল্লির স্বার্থ বিবেচনায় অস্থির এবং প্রতিকূল হিসেবে চিত্রিত করার জন্য। বিজেপি, আরএসএস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস এই আখ্যানগুলোকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে।


শেখ হাসিনার পতন ভারতের স্বার্থে যে কৌশলগত ধাক্কা দেয় তার জবাবে ভারত তার টুলসগুলোকে একত্রিত করে একটি আক্রমণাত্মক বহু-স্তরীয় প্রচারণা সক্রিয় করে। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য ঐতিহ্যগত প্রচার এবং উন্নত পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধকৌশল নিয়ে বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারে তার প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টা বজায় রাখে।


ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সঙ্কটকে গভীরতর করার জন্য অত্যাধুনিক বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করেছে। সোস্যাল মিডিয়াকে ম্যানিপুলেশন করে হাজার হাজার ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তাতে বিভ্রান্তিকর বিষয়বস্তু, বানোয়াট ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট ও গুজব ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি সিটিজেন জার্নালিজম এবং প্রক্সি নেটওয়ার্কের একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, যা ভারত-সমর্থিত কর্মীরা গোপনে ব্যবহার করছে প্রোপাগান্ডা করার জন্য।


এই প্রচারযুদ্ধের পেছনে ভারতের প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, অন্তবর্তী সরকারকে হেয় করা এবং এর ক্ষমতার প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট করা। এই লক্ষ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উপদলের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করার একটি কৌশলও নেয়া হয়েছে। এটি করে প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশের জন্য নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে অবস্থান সৃষ্টি করতে চাইছে। যাতে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয় যেখানে ভারতের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। 


বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সংহতি নষ্ট করতে ভারত পরিকল্পিতভাবে রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক ফল্ট লাইনগুলোকে দুর্বল করার কৌশল গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে আগস্ট বিপ্লবের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রভাব কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করা হচ্ছে । ভারত আমাদের প্রতিবেশী দেশ। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখতে চায় বাংলাদেশ। বরাবরই সেটা করে আসছে। কিন্তু তাদের আগ্রাসন আর আধিপত্যবাদ দীর্ঘ দিন ধওে এমন ভাবে চেপে ধরে আছে তা গেলো ৫ আগষ্ট থেকে ফাটল ধরেছে। তবে এ দেশের মানুষ যেমন শান্তিপ্রিয় তেমনি ফ্যাসিবাদ তাড়তে যেমন রক্ত দিয়েছে । দেশের জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষায় তারা আবারো জেগে উঠবে। প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করবে পতাকার সম্মান।  


কামাল উদ্দিন সুমন,

সিনিয়র সাংবাদিক।

স্থায়ী সদস্য, জাতীয় প্রেসক্লাব ।


 

সম্পর্কিত বিষয়: