কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন একজন সেই কন্ঠস্বর যার কবিতা আমাকে আলোড়িত করে। চমৎকরা রচনা শৈলী ও ছন্দের তথ্যের অবাধ প্রকাশ রয়েছে তার কবিতায় ও লেখায়। তার হাত ধরে প্রসার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের, হয়েছে সমৃদ্ধ ও বিত্তশালী লেখনীর প্রকাশ।
তার হাত ধরেই এগিয়ে যাক বাংলা কবিতা দেশ থেকে দেশান্তরে। আসছে ২২ নভেম্বর এই গুনিজনের ৬২তম জন্ম দিন। শুভ কামনা নিরন্তন লেখক “রেজাউদ্দিন স্টালিন”। আমি তার জন্মদিনে মঙ্গল কামনা করছি।
যা না বললেই নয়, রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ও প্রভাবশালী কবি তারুণ্যের প্রতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।
তাঁর কবিতায় প্রেম, প্রতিবাদ, মানবিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের মেলবন্ধন অসাধারণ শৈলীতে উঠে আসে, যা পাঠকদের গত চার দশক ধরে মুগ্ধ করে রেখেছে। সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রধানত কবিতা, তবে তিনি গল্প, প্রবন্ধ এবং গবেষণাধর্মী রচনাও রচনা করেছেন।
বাংলাভাষার কবি হয়েও তিনি বিশ্বজনীন। তিনি তার সময়ে বাস করেন এবং আগামী শতকের স্বপ্ন বয়ন করেন। তার লেখা ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, উড়িয়া, স্প্যানিশ, গ্রিক, রোমানিয়ান, ফরাসী, জাপানি, নাইজেরিয়ান, নেপালি, সুইডিশ, জার্মান, চিনা, আজারবাইজানী, ভিয়েতনামী, পর্তুগিজ, সার্বিয়ান, রুশ, কাজাক, কোরিয়ান, তাইওয়ানীয়, ইন্দোনেশিয়ান, আলবেনীয়, বুলগেরিয়ান, পোল, ইতালীয়, আরবি, আফ্রিকান, তার্কিশ, ফার্সিসহ ৪২টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
সাহিত্য চর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার, দার্জিলিং নাট্যচক্র পুরস্কার, ভারতের সব্যসাচী পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গের সেন্টার ফর স্টেজ সম্মাননা, সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার, খুলনা রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার, ধারা সাহিত্য আসর পুরস্কার, তরঙ্গ অফ ক্যালিফোর্নিয়া সম্মাননা, লসএঞ্জেলস বাদাম সম্মাননা, লসএঞ্জেলস রাইটার্স ক্লাব সম্মাননা, ইংল্যান্ড জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন সম্মাননা, গান্ধী শান্তি পুরস্কার, ভারত নিকোলাই গোগোল ট্রায়াম্ফ আন্তরিক পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশের বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
এই গুনি লেখক কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর বৃহত্তর যশোরের নলভাঙা জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা- শেখ বোরহানউদ্দিন আহমেদ। মাতা রেবেকা সুলতানা। অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ। নজরুল ইন্সটিটিউটের সাবেক উপ পরিচালক ছিলেন।
কৈশোরেই তিনি লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৭০ সালে যশোর থেকে প্রকাশিত শতদল পত্রিকায় প্রথম 'শপথ' নামে কবিতা প্রকাশ হয়। তার লেখা শতাধিক গ্রন্থ ও ৬৫টি কাব্যগ্রন্থ অনূদিত হয়েছে।। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-ফিরিনি অবাধ্য আমি, ভেঙে আনো ভেতরে অন্তরে, সেইসব ছদ্মবেশ।
আঙুলের জন দ্বৈরথ, হিংস্র নৈশভোজ, ভাঙা দালানের স্বরলিপি, সব জন্যে শত্রু ছিলো যে, জ্যামিতি বাক্সের গল্প, তদন্তরিপোর্ট, অবুঝ যাদুঘর, প্রতিবিদ্যা, অস্ত্র ভাঙার মুহূর্ত, ডায়োজেনিসের লণ্ঠণ।
ছড়াগ্রন্থ - হাঁটতে থাকো, শৈশব, চিরশিশু। গদ্যবই রবীন্দ্রনাথ আরোগ্য, নজরুলের আত্মত্ম নৈরাতা, নির্বাসিত তারুণ্য, কাঠ কয়লায় লেখা। সম্পাদিত পত্রিকা- রৌদ্রদিন, পদাবলি।
তার ভিডিও সিডি ১০টা। আবৃত্তি এ্যালবাম-৬টা। প্রদীপ ঘোষের কণ্ঠে আবৃত্তি এ্যালবাম-আবার একদিন বৃষ্টি হবে। তিনি ভারত, নেপাল, দুবাই, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও চীনসহ বহুদেশে ভ্রমন করেছেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন বাংলাদেশের কবিতাভুবনে প্রাজ্ঞ কণ্ঠ; আশির দশকে আবির্ভূত হয়ে ইতোমধ্যে সমগ্র বাংলা কবিতায় নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন একটি স্বকীয় কাব্যভুবন। আত্মতা এবং আমিত্বই স্টালিনের সাহিত্যকর্মের মুখ্য উপজীব্য নয় বরং এক বৈশ্বিক সর্ব মানবের সংগ্রাম ও সাফল্যের ঐতিহাসিক শিল্পীত দলিল তাঁর কবিতা।
আত্মপ্রীতি, দুঃখবোধ আর স্বপ্নপীড়িত বেদনা নিয়ে স্টালিন ডুবে থাকতে চেয়েছেন তাঁর অন্তস্থলে; কিন্তু সংবেদনশীল শিল্পসত্তা তাঁকে অন্তর্লোকের অতল থেকে বার বার তুলে এনছে বহির্লোকের প্রাঙ্গণে।
সময়জ্ঞান, ইতিহাসচেতনা, পুরাণস্মরণ এবং মৃত্তিকা সংলগ্নতার শক্তি নিয়ে বেজাউদ্দিন স্টালিন অতিক্রম করে যান তাঁর কালের বৈনাশিকতা আর বিভক্ততা, সময়ের নষ্ট অক্রোশ। পৌরাণিক উৎস থেকে স্টালিন পৌনঃপুণিকভাবে চয়ন করেছেন তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার বীজ, তাঁর কাব্যাঙ্কুর।
স্টালিনের কৃতিত্ব এই তাঁর জাদুবাস্তবতা ও পুরাণচেতনা সমকালসংলগ্ন ঐতিহ্য এবং পুরাণকে পুনর্লিখন না করে তিনি তাকে করে তোলেন প্রতিঅর্থে সৃষ্টিশীল। সংরক্ত স্বকালের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে স্টালিনের কবিতা পুরাণ বিকিরণ করে নতুন মাত্রা, নবতর ব্যঞ্জনা। আর তিনি হয়ে ওঠেন এই উপমহাদেশের আন্তর্জাতিক কণ্ঠস্বর।
তাঁর কাব্যিক বাক্যবিন্যাস এবং শব্দের প্রয়োগ, অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্তর্নিহিত দর্শনের জন্য তাঁকে আধুনিক বাংলা কবিতার এক অন্যতম স্রষ্টা বলে গণ্য করা হয়।
এই মহা কবির ৬২ তম জন্মদিনে আবারও শুভেচ্ছা জানাই। সেই সাথে তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা। তার হাত ধরেই চলমান থাকুক আধুনিক বাংলা সাহিত্য।
---লিজা কামরুন্নাহার, কবি ও সংবাদিক।