আইবিএস (IBS) হলো অন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের একটি সমস্যা। এটি পেটের পীড়ার কয়েকটি উপসর্গ বা লক্ষণের সমষ্টি । পৃথিবীতে একটি প্রচলিত রোগের নাম এটি । সাধারণতঃ ২০ থেকে ৪০ বছরের মহিলাদের ও মানসিক অস্থির প্রকৃতির পুরুষের মধ্যে আইবিএসের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে পুরুষের চেয়ে নারীদের প্রায় ২-৩ গুণ এ সমস্যায় ভোগে। পাশ্চাত্য দেশেগুলোতে প্রতি ১০০ জনে মধ্যে প্রায় ১০-১৫ জন এই রোগে ভুগছেন। নাটোরের একটি গ্রামে চালানো সমীক্ষার প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন পুরুষের মধ্যে ২০ জন ও প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ২৭ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়। সামগ্রীকভাবে এদের মোট সংখ্যা গড়ে ২৪% জন। এখন পর্যন্ত এ রোগের প্রকৃত কারণ জানা যায়নি । তবে এটি খাদ্যনালীর বা অন্ত্রের একটি রোগ ।
কারণঃ
আইবিএস নিয়ে বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অনেক গবেষণা করছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত এই রোগের কোনো প্রকৃত ও স্বীকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে একে "ফাংশনাল ডিসঅর্ডার"ও বলে। তবে আইবিএসের কারণ ও প্রভাবক হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা অনেক বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো দুটি ভাগে ভাগ করা যায় : মনঃসামাজিক ও শারীরবৃত্তীয়।
দুশ্চিন্তা, হতাশা,অতিরিক্ত মানসিক চাপ ইত্যাদি হলো আইবিএসের মনঃসামাজিক কারণ। আর খাদ্যনালির অতি সংবেদনশীলতা, খাদ্যনালির নাড়াচাড়ার অস্বাভাবিকতা বা অন্ত্র থেকে মস্তিষ্কে পাঠানো বার্তায় ত্রুটি ইত্যাদি হলো শারীরবৃত্তীয় কারণ। এছাড়াও অন্ত্রের প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিবর্তন, অন্ত্রের নিজস্ব জীবাণুর পরিবর্তন, খাদ্যনালীর কোন সংক্রমন, হরমোন সমস্যা (নারীদের মাসিকচক্রের সঙ্গে), মাদক গ্রহণ, পেটের যে কোনো অপারেশন প্রভৃতি এটির কারণ এবং দীর্ঘকাল ধরে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কারণে আইবিএসের সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
লক্ষণঃ
আইবিএসকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায় । যথা: কোষ্ঠকাঠিন্যপ্রধান ও আমাশয়প্রধান। এর লক্ষণগুলো হলো :
পেট ব্যথা, পেটে মোচড় বা কামড় দিয়ে পায়খানার বেগ আসা, কিছু খাইলেই পেট ব্যথা করে, আমাশয়, পাতলা পায়খানা, কোষ্ঠকাঠিণ্য, পেটের মধ্যে পুটপুট করা, গড় গড় শব্দ করা, পেট ফুলে থাকা, দুধ ডিম মাছ মাংস শাক খাইলে আমাশা ও পাতলা পায়খানা দেখা দেয়। পেটের নিচের অংশের যে কোন একপাশে বা মাঝখানে বা নোভীর গোড়ায় অল্প বা প্রচন্ড ব্যথা, পেটের ভিতর অস্বস্তিবোধ ,সেই সঙ্গে ঘন ঘন পায়খানার বেগ। কারো কারো সারাদিনই এরকম পায়খানার বেগ থাকে। পায়খানা নরম বা পাতলা বা আমযুক্ত বা শক্ত গুটলে দলা-দলার মত হয়। কখনও কখনও কারো কারো পায়খানার বেগ আসে কিন্তু পায়খানা হয় না, হইলেও একেবারে অল্প হয়, পায়খানার পর পেটে স্বস্তিবোধ বা আরো পায়খানা করার ইচ্ছা,পায়খানা ক্লিয়ার হয়না, মনে হয় পায়ুপথের মধ্যে আর মল রয়েগেছে ,সারাদিনই অস্বত্বিবোধ।কারো কারো কিছু খাওয়া অবস্হায় বা খাওয়া মাত্রই পায়খানার বেগ আসে ও পেটে ব্যথা হয় এবং উক্ত লক্ষণসহ নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক চলাকালীন কিংবা মিলনের সময় ব্যথা। এছাড়া অন্য যেসব লক্ষণ থাকতে পারে, সেগুলো হলো, শারীরিক অবসাদ ও দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পিঠে ব্যথা, কোমরে ব্যথা, ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ ,পেটে অত্যধিক গ্যাস জমা হয়ে পেট ফুলে থাকা,গলা-বুক জ্বালা, বদহজম ,অরুচি ইত্যাদি।
চিকিৎসাঃ
উপরিউক্ত সমস্যাগুলো ছয় মাসের বেশি হলে চিকিৎসকরা আইবিএস হয়েছে বলে ধরে নেন। তখন মানসিক অস্থিরতা ও আচরণগত সমস্যা উভয়েরই চিকিৎসা করতে হয়। মূলত শরীর থেকে মানসিক চাপ কমে গেলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ তবে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রোগ নয়, সংক্রমক রোগও নয়, এ রোগের কারণে অন্ত্রের ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সংক্ষেপে ডায়রিয়াপ্রবণ আইবিএসকে IBS-D, কোষ্ঠকাঠিন্যপ্রবণ আইবিএসকে IBS-C এবং উভয় লক্ষণ সমস্টির আইবিএসকে IBS-M হিসেবে অভহিত করে সেই লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। আর এ রোগের জন্য সম্পূর্ণ প্রতিকারমূলক লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা হলো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে প্রায় ১থেকে ৩মাস হোমিও ওষুধ সেবন করলে ইহা সম্পূর্ণ আরোগ্য হয় । প্রাথমিকভাবে Nux vomica, colocynth, Merc sol, Aloe soc, Crotontig, pulsetilla, Ipecac, Lycopodium, Natrum Sulp ,Chelid maj, Hydrastis can প্রভৃতি ওষুধ লক্ষণানুসারে যে কোন ১টি বা ২টি ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে পারেন কিন্তু রোগের তীব্রতা, হ্রাস-বৃদ্ধি, রোগের কারণ ও উৎস অনুসন্ধান, রোগীর আহার নিদ্রা, রুচি-অরুচি, ঠান্ডা-গরমে ও নড়াচড়ায় রোগের হ্রাস বা বৃদ্ধি, ধাতুগত ও মানসিক লক্ষণ ইত্যাদি উপসর্গ অনুসারে উক্ত ওষুধের ডোজ, মাত্রা, শক্তি , একজন চিকিৎসকই নির্ধারণ করতে পারেন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা দরকার।
পরীক্ষাঃ
সাধারণত উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে আইবিএস রোগটি নির্ণয় করা যায়। রোগীর বয়স ও সুনির্দিষ্ট লক্ষণের ওপর নির্ভর করে এক বা একাধিক পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। ৪০ বছরের কম বয়সী রোগীদের ক্ষেত্রে লক্ষণের ওপর নির্ভর করে রোগ শনাক্ত করা যায়। বয়স ৪০ বছরের ওপরে হলে কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। তবে আইবিএস রোগীর ক্ষেত্রে এসব পরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক থাকবে। পরীক্ষাগুলো হল-সিবিসি, এএলটি, কলোনস্কোপি, সিগময়ডোস্কপি, থাইরয়েড হরমোন, মল পরীক্ষা ইত্যাদি। তবে কলোনস্কোপি,সিগময়ডোস্কপি অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে করানো উচিত। কারণ অনেক সময় মলদ্বার ও বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার রোগীদেরও একই ধরনের উপসর্গ থাকে। এজন্য আইবিএসকে অনেকে ক্যান্সার মনে করে ভয় পায়। এই উদ্বেগ থেকে তাদের পেটর সমস্যা আরো বেড়ে যায়। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের আশ্বস্ত করা উচিত যে এটি ক্যান্সারজাতীয় কোনো সমস্যা নয়। সঠিক হোমিওচিকিৎসায় আইবিএস সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়।
সতর্কতাঃ
লিভার গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান "দ্য লিভার সেন্টার", ঢাকা এর গবেষণা মতে, যেসব রোগীর দীর্ঘমেয়াদি লিভারে প্রদাহ এবং ফ্যাটি লিভার থাকে তাদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো সময় আইবিএসে আক্রান্ত হয়। আবার যারা পায়খানার অভ্যাসের পরিবর্তন, পেট ফোলা, পেট ব্যথা বা অস্বস্তি, পেটে শব্দ, সুনির্দিষ্ট কিছু খাদ্য হজম না হওয়া এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে আসে, তাদের প্রথম প্রথম আইবিএস হিসেবে সন্দেহ এবং চিকিৎসা করা হলেও পরে লিভার সিরোসিস ধরা পড়ে। তাই আইবিএস রোগীদের লিভারের কোনো সমস্যা আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। আবার দীর্ঘমেয়াদি আইবিএসের কারণে অনেক রোগীর অর্শ্ব বা পাইলস, মলদ্বার ফাটাফাটা বা এনাল ফিশার, ফিস্টুলা ইত্যাদি রোগও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পায়খানার রাস্তা দিয়ে রক্ত যেতে পারে, পায়খানার রাস্তা ফুলে উঠতে পারে, পায়খানা করার পর চুলকায় ও জ্বালা-যন্ত্রণা করতে পারে অথবা কারো কারো পায়খানার রাস্তা বের হয়ে আসতে পারে। সুতরাং পেট ও পায়ুপথের সমস্যা দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই দক্ষ ও অভিজ্ঞ হোমিওচিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হোমিও ওষুধ সেবন করলে অল্পতেই রোগটি আরোগ্য করা সম্ভব এবং উক্ত সমস্যা থেকে পায়ুপথে কোনো রোগ আসার সম্ভাবনা থাকলেও তা প্রতিরোধ ও প্রতিকার করাও সম্ভব। এটিই হোমিওচিকিৎসার বিশেষ কৃতিত্ব।
নিষেধ ও পরামর্শঃ
যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যপ্রধান আইবিএস রোগের রোগী তারা আঁশ বা ফাইবারযুক্ত খাবার খাবেন ,শাকসবজি ও ফল খাবেন।কলা পেটের জন্য উপকারী তাই বেশি করে কলা খাবেন কিন্তু যাদের সবরিকলা ও বিচিকলা খাইলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয় তারা সবরিকলা ও বিচিকলা খাবেন না। আর যাদের আমাশয় ও পাতলাপায়খানা প্রধান আইবিএসের রোগী তারা কাচা কলা, লাউ, জালিকুমড়া, পেঁপের তরকারি খেতে পারেন , আর ডিম, দুধ, ছানা, মাখন এবং যা খাইলে পেটের পীড়া বেড়ে যায় তা খাবেন না ।
নিয়মিত ব্যায়াম, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম করুন। দুশ্চিন্তা একেবারে দূর না করা গেলেও সহনীয় পর্যায় নিয়ে আসেতে হবে। খাবারের পর পরই ঘুমানো যাবে না এবং রাতের খাবার ঘুমানোর দুই ঘন্টা পূর্বে খেতে পারলে ভালো হয় এবং খাবারের পরে ও ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ হাঁটলে ভালো হয়। সকল প্রকার বাহিরের খোলা খাবার, ভাঁজাপোড়া ও ফাস্ট ফুড এবং যে খাবার আপনার পেটে সহ্য হয় না তা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখুন।
আর একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন তা হলো প্রথমেই রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে নিতে হবে। ঔষধ সেবনকালীন নতুন কোন উপসর্গ দেখা দিলে তা ডাক্তারকে জানাতে হবে। তাহলেই এ রোগের চিকিৎসায় ভালো ফল পাওয়া যাবে। রোগীর উপসর্গ কমে না বলে রোগী ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করেন। ঘন ঘন চিকিৎসক পরিবর্তন করলেই ভালো ফল পাওয়া যায় না। তাই ধর্য্যসহকারে এ রোগের চিকিৎসা নিতে হবে। বিদেশী এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আইবিএস রোগীদের মধ্যে ১০ শতাংশ এলোপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেন এবং অধিকাংশ রোগী সামান্য ব্যবস্থাপনায়ই উপশম লাভ করেন এবং এদের ২৫ শতাংশ রোগীর উপসর্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি তাদের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ হয়ে যেতে পারে। এলোপ্যাথি চিকিৎসায় আইবিএস নিয়ন্ত্রণ রাখা যায় মাত্র আর সাথে সাইড এফেক্টতো আছেই। প্রকৃতপক্ষে হোমিওচিকিৎসায় রোগটি আরোগ্য করা সম্ভব। তাই রোগীদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাই নেওয়া দরকার।
ধুমপানসহ নেশাগ্রস্তরা নেশা পরিহার করুণ।চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুণ,সুস্হ থাকুন। এবং প্রাকৃতিক বস্তু গ্রহণ করুন, সুস্হ জীবনযাপন করুন।
লেখক-
ডা.গাজী খায়রুজ্জামান
হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ও স্বাস্হ্যবিষয়ক কলামিস্ট।
মোবাইলঃ ০১৭ ৪৩ ৮৩ ৪৮ ১৬