৫ আগস্টের আগেও ছিলেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা শামীম ওসমান এবং ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শওকত আলীর ঘনিষ্ঠজন। এমনকি, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং হামলা চালানোর ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলাও রুজু হয়েছে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর সেই ব্যক্তি খোলস পাল্টে এখন হতে চাইছেন বিএনপির একনিষ্ঠ কর্মী। বলছি বক্তাবলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুর রশিদের কথা।
এলাকাবাসী জানায়, পূর্বে নিজেকে আওয়ামীলীগের বড় নেতা দাবি করে শামীম ওসমান ও শওকত আলীর সাথে বড় বড় পোস্টার সাটানো রশিদ মেম্বার বর্তমানে পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন বিএনপির ত্যাগী নেতা হিসেবে। এই পরিচয়ে বক্তাবলী ফেরিঘাটসহ বিভিন্ন সেক্টর দখলেও নিয়েছেন তিনি। যদিও কখনোই বিএনপির কোনো পদে ছিলেন না, এমনকি বিগত সময়ে বিএনপির কোনো মিটিং মিছিলেও ছিলেন না তিনি, জানায় দলটির নেতাকর্মীরা। তবুও তিনি বিএনপির অনেক বড় নেতা, আর এই পরিচয় ব্যবহার করেই বক্তাবলী ইউনিয়নে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দখল-চাঁদাবাজিতে।
এই দখল-চাঁদাবাজিকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিতে এবং আরও পাকাপোক্ত করতে নিজেকে বক্তাবলী ইউনিয়নের স্বঘোষিত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবেও পরিচয় দিয়ে বেড়াচ্ছেন সর্বত্র। অভিযোগ উঠেছে, মোটা অংকের টাকা এবং চাপের মুখে কয়েকজন মেম্বারকেও বশে এনেছেন রশিদ মেম্বার। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদেরকে সাথে নিয়ে গত রবিবার নারায়ণগঞ্জ জেলা স্থানীয় সরকার এর কর্মকর্তার কার্যালয়ে গিয়ে পূর্বের প্যানেল বাতিল এবং নতুন প্যানেল গঠনের বিষয়টি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিজেকে বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার সুপারিশ জানায় রশিদ মেম্বার। তবে, এমন বিধি বহির্ভূত কাজে সায় দেননি স্থানীয় সরকারের উপ-পরিচালক মৌরিন করিম। তিনি জানিয়েছেন, বিধি অনুযায়ী চেয়ারম্যানের পরিবর্তে প্যানেল চেয়ারম্যান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবে। নিয়ম বহির্ভূত ভাবে নতুন প্যানেল গঠনের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেন মৌরিন করিম।
জানা গেছে, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিধান রয়েছে ১নং প্যানেল চেয়ারম্যানের। কোনো কারণে ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে পর্যায়ক্রমে ২ অথবা ৩নং প্যানেল চেয়ারম্যান বসবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। তবে বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদে সেই নিয়ম মানতে নারাজ বিতর্কিত ও আওয়ামীলীগের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ১নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুর রশিদ। ১ থেকে ৩নং প্যানেল চেয়ারম্যান থাকলেও আব্দুর রশিদ সেই প্যানেলকে তোয়াক্কা না করে নিজেই নিজেকে দাবি করছেন ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান হিসেবে।
এ বিষয়ে বক্তাবলী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার ও ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান আকিল উদ্দিন বলেন, ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদ এর সাধারন নির্বাচনে আমি ২নং ওয়ার্ডের মেম্বার নির্বাচিত হই। ২০২২ সালের ২৭ জানুয়ারী মেম্বারদের সমর্থনে আমি প্যানেল চেয়ারম্যান-১ নির্বাচিত হই। ইতিপূর্বে বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের অবর্তমানে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই থেকে ০৪ আগস্ট পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বও পালন করি।
তিনি বলেন, ০৫ আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব পূরবী গোলদার স্বাক্ষরিত পরিপত্র আমার কাছে আসে। যেখানে উল্লেখ আছে, অনুপস্থিত চেয়ারম্যানের কাজ পরিচালনা ও জনসেবা অব্যহত রাখার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ আইন ২০০৯ ধারা ৩৩, ১০১, ১০২ অনুযায়ী বিভাগীয় কমিশনার বা জেলা প্রশাসক সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান কে আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্পন করিবেন। সেই মোতাবেক গত ২২ আগস্ট আমি নিয়মিত ভাবে পরিষদে বসতে গেলে ৬নং ওয়ার্ড মেম্বার রাসেল চৌধুরী সহ আরো কুচক্রী মহলের সহযোগীতায় ১নং ওয়ার্ড মেম্বার রশীদ আমাকে ইউনিয়ন পরিষদের নিয়মিত কাজকর্ম করিতে বাধা প্রদান করে। তিনি আরও বলেন, বাধা প্রদানের মধ্য দিয়ে তারা স্থানীয় সরকার বিভাগের আদেশ অমান্য করে বে-আইনী কাজ করেছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিপত্র অনুযায়ী আমিই বক্তাবলী ইউনিয়ন এর বৈধ প্যানেল চেয়ারম্যান।
অভিযোগ উঠেছে আব্দুর রশিদ মেম্বার মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ২/৩ জন মেম্বারকে ম্যানেজ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অথচ, সরকারি আইন মোতাবেক চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে তিনজন প্যানেল চেয়ারম্যানের মধ্যে একজন। কিন্তু প্যানেল চেয়ারম্যান থাকা সত্বেও নিয়মের কোন তোয়াক্কা করছে না আব্দুর রশিদ মেম্বার। অথচ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া এবং হামলা চালানোর ঘটনায় রশিদ মেম্বারের বিরুদ্ধেও ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় হত্যা মামলা ছিল। বর্তমান চেয়ারম্যান শওকত আলী মামলার কারণে চেয়ারম্যান এর পদ হারাতে বসেছে। কিন্তু রশিদ মেম্বারও হত্যা মামলার আসামি হলেও তিনি চেয়ার দখলের চেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। হত্যা মামলার আসামী হয়েও প্রশাসনের নাকের ডগায় থেকে কিভাবে দাপট দেখাচ্ছে রশিদ মেম্বার- সেই প্রশ্ন স্থানীয়দের।
এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় এক বিএনপি নেতার সাথে আতাত করে ধরাকে সরা বলে পুরো বক্তাবলীতে দখল-চাঁদাবাজির রাম রাজত্ব কায়েমে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিতর্কিত এই রশিদ মেম্বার। এমনকি, এলাকায় বিচার-শালিসের নামে টাকা খেয়ে অন্যায়ভাবে রায় দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়াও, আরও ব্যাপক অভিযোগে অভিযুক্ত আব্দুর রশিদের দাম্ভিকতার যেন শেষ নেই।
এসকল বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত রশিদ মেম্বারকে কল করা হলে, তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে প্রথম ফোন কেটে দেন। পুনরায় কল করা হলে, প্রশ্ন শুনেই রাগান্বিত হয়ে পড়েন এবং পুনরায় কল কেটে দেন। এরপর বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেন নি।