নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

শুক্রবার,

২২ নভেম্বর ২০২৪

২১ ঘন্টা পর গাজী টায়ার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রনে, নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের ভীড়

নারায়ণগঞ্জ টাইমস

প্রকাশিত:২১:০৯, ২৬ আগস্ট ২০২৪

২১ ঘন্টা পর গাজী টায়ার কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রনে, নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনদের ভীড়

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী এলাকায় গাজী গ্রুপের টায়ার তৈরির কারখানায় লুটপাট চালিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। রোববার দিবাগত রাত ৯টার দিকে আগুন দেওয়ার এ ঘটনা ঘটে বলে জানান কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম। 

এদিকে অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডেমরা, কাঁচপুর, আদমজী ইপিজেড ও কাঞ্চন ফায়ার স্টেশনের মোট ১২ টি ইউনিট রাত পৌনে ১২টা থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা শুরু করে। পরে আগুন নেভাতে রাজধানির সিদ্দিকবাজার থেকে টিটিএল মেশিন নিয়ে এসে উপর থেকে পানি ছিটানোর কাজ শুরু হয়।

আগুন লাগার  ২১ ঘণ্টা পর সোমবার (২৬ আগস্ট) রাত ৭টা ৫ মিনিটের দিকে ফায়ার সার্ভিসের কমীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। তবে ওই সময়ও কিছু কিছু ন্থানে মৃদু মৃদু আগুন দেখা যায়।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লে. কর্নেল মো. রেজাউল করিম এ তথ্যটি নিশ্চিত করে বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ১২ ইউনিটের প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। হতাহতের বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা উদ্ধার কাজ এখনো শুরু করতে পারিনি কারণ ভবনটিতে অস্বাভাবিক আগুনের তাপ রয়েছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলেই উদ্ধার কাজ শুরু করা হবে।

ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও প্রশাসনের লোকজন নিখোঁজের তালিকা করছেন। স্বজনরা যারা দাবি করছেন তাদের নাম, ঠিকানা লিখে রাখছি। এখন পর্যন্ত এ তালিকায় যাদের নাম লেখা হয়েছে যারা গত রাতে লুটপাটের সময় এই কারখানায় এসেছিলেন। তবে তারা কেউ কারখানার শ্রমিক নন বলে জেনেছি আমরা। 

স্থানীয়দের দাবি, ভবনটিতে ৪০০ থেকে ৫০০ মানুষ আটকা পড়েছেন। তারা জীবিত আছেন কিনা সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। 

তারা জানান, গত রবিবার (২৫ আগস্ট) বিকেলে কারখানার মালিক নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে নারায়ণগঞ্জের আদালত ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে এর পর পর রূপগঞ্জের রূপসি এলাকায় আনন্দ মিছিল বের করে বিএনপি ও বিভিন্ন সহযোগি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। 

এসময় শত শত মানুষ গাজী টায়ার কারখানার ভেতরে প্রবেশ করে মেশিনপত্র ও আসবাবপত্র সহ বিভিন্ন সামগ্রী লুটপাট করে নিয়ে যেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে লুটপাটের ঢল চলতে থাকলে প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ ছয়তলা ভবন টির বিভিন্ন ফ্লোরে উঠে পড়েন। সেখান থেকেও লুটপাট শুরু হয়। 

রাত নয়টার দিকে ভবনের নীচতলায় দূর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিলে এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে। এসময় দুই তলা ও তিন তলার জানালা দিয়ে অনেকেই নীচে লাফিয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে আগুন একে একে ছয় তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেলে ভেতরে আটকে পড়া অনেকেই আর বের হতে পারেননি বলে এলাকাবাসি দাবি করছেন। 

কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল বলেন, হামলা শুরুর পর থানাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিলে সেনাবাহিনীর একটি টিম আসে গেটের সামনে। কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি তারা দাঁড়াননি। পরে আগুন দেয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসে।

এদিকে নিখোঁজদের খোঁজে কারখানার সামনে স্বজনেরা ভিড় জমিয়েছেন। বেশ কয়েকজন স্বজনের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা বলছেন, গতকাল বিভিন্ন সময় তাঁদের স্বজনেরা কারখানায় এসেছেন। তাঁরা কেউই কারখানার শ্রমিক নন। পরে আর তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাত থেকে মুঠোফোনও বন্ধ।

কারখানার সামনে দুই বছরের ছেলে আদনানকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন গৃহবধূ মোসা. রুবি। তিনি বলেন, তাঁর স্বামী মো. সজিব (২৬) গত রাত ৯টা থেকে নিখোঁজ। সজিব উপজেলার মুড়াপাড়া গঙ্গানগর এলাকার শহীদ মিয়ার ছেলে। সজিব রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করতেন জানিয়ে রুবি বলেন, কারখানায় লুটপাট হইতাছে শুনে সজিব কারখানায় আসে। রাত ৯টায় শেষবার কথা হয়। তখন সে কারখানায়ই ছিল। পরে আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

বরপা এলাকার ইকবাল হোসেন বলেন, আমার বন্ধু আলী আসাদ, আবু সাঈদ, স্বপন খাঁন, শাহিনসহ ৫ জন নিখোঁজ রয়েছে। তারা কারখানার ওই ভবনে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢুকে আর বের হয়নি। মোবাইল ফোনে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কথা হয়েছে। তখন বলেছে তারা ভবনে আটকা পড়েছে। আমাদের বাঁচান। এরপর আর ফোনে পাওয়া যায়নি।  

কোনাপাড়া এলাকার রাবেয়া খাতুন বলেন, তার মেয়ের জামাই হযরত আলী গাজী টায়ার কারখানায় মালামাল নিতে আসছে। বাড়ি থেকে বলে আসছে। এখন আর তার খোজ পাচ্ছিনা। শুনছি আগুন লাগছে যেই ভবনে সেখানে আটকা পড়েছে।

মাসাবো এলাকার আসাদ মিয়া বলেন, তার ছোট ভাই বাবু মিয়া কসাইয়ের কাজ করেন। বন্ধুদের সঙ্গে গাজীর কারখানা থেকে মাল নিতে আসে। রাত ১০টা পর্যন্ত কথা হইছে এরপর থেকে আর কথা হয়নি।

বরপা এলাকার সুরাইয়া বেগম বলেন, রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার নাতি নিরব ও তার বন্ধু মিল্লাত মিলে টায়ার কারখানায় প্রবেশ করে। পরে যেই ভবনে আগুন লেগেছে ওই ভবনে আটকা পড়ে। এখন আর খোঁজ পাচ্ছিনা।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রেজাউল করিম আরও জানান, আমরা ভবনের ভেতর থেকে আহত ১৪ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করেছি। তারা এ কারখানার কর্মী নন, মূলত কারখানাটির মালামাল সরিয়ে নিতে তারা এসেছিলেন। তবে ভেতরে কি পরিমান মানুষ আটকা পড়েছিলেন সেটি এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে আগুনের সংবাদে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসময় তিনি বলেন, দলীয় নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ অপরাধ করলে সাংগঠনিক ভাবে দল থেকে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

গাজী সাহেব অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার করা হবে। কিন্তু সাধারন মানুষের রুটি রোজগারের জায়গা এই কারখানা। কারখানা ধ্বংশ করলে এখানে কর্মরত ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কোথায় যাবে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান মাহমুদ রাসেল বলেন, কেউ কোন প্রকার অরাজকতা, লুটপাট, আইনশৃংখলার অবনতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করলে আইনশৃংখলা বাহিনী তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিবে। প্রচলিত আইনে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

গাজী টায়ার ফ্যাক্টরির এডমিন ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাঙচুর লুটপাট অগ্নিসংযোগে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। সরকারের সহযোগিতা পেলে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানাটি পুনরায় চালু করা হবে।

উল্লেখ্য, এর আগে গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গাজীর রূপসী ও কর্ণগোপের দুটি কারখানায় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।