বামে ডেভিল এক্সো গ্রুপের লিডার সারিব মাঝে শেল্টারদাতা শফিকুল ডানে টেনশন গ্রুপের লিডার সীমান্ত
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ২নং ওয়ার্ডে আতঙ্কের নাম কিশোরগ্যাং সন্ত্রাসীদের নিয়ে গঠিত ‘টেনশন গ্রুপ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপ’। ইভটিজিং, চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মাদক বিক্রি ও মাদক সেবনসহ এমন কোন অপকর্ম নাই যা এই দুই বাহিনী করে না।
মিজমিজি পশ্চিমপাড়া এলাকার মৃত শহিদুল ইসলামের ছেলে শফিকুল ইসলাম শফির সরাসরি শেল্টারে এই বাহিনী গড়ে উঠেছে। বাহিনীর প্রধান হচ্ছে রাইসুল ইসলাম সীমান্ত ও ডেভিল এক্সো গ্রুপের লিডার সাকিবুল ইসলাম সারিব।
সবশেষ চলতি বছরের ২৪ মার্চ দুই বাহিনীর প্রধান সীমান্ত ও সারিবসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। বেশ কিছুদিন কারাভোগের পর জামিনে বেরিয়ে এসে ফের শুরু করে অপকর্ম।
এর ধারাবাহিকতায় ২১ মে রাতে সাদমান চৌধুরী (২১) নামে এক যুবককে মারধর করে তার আই ফোন-৭, গলার স্বর্ণের চেইন, আংটি ছিনিয়ে নেয় টেনশন গ্রুপের প্রধান রাইসুল ইসলাম সীমান্ত ও তার লোকজন।
এখানেই শেষ নয়, পরে সাদমানের পরিবারের কাছে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এ ঘটনায় সীমান্তসহ দুইজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০ জনকে আসামী করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সন্ধ্যায় টেনশন গ্রুপের অন্যতম সদস্য মো. রাহাত হোসেন (২৪) মিজমিজি দক্ষিণপাড়ায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে রিয়াদুল ইসলাম (২৯) নামে এক যুবকের মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। এসময় ওই যুবক বাধা দিলে তাকে বেধড়ক মারধর করে রক্তাক্ত জখম করে।
একপর্যায়ে হত্যার উদ্দেশ্যে সন্ত্রাসী রাহাত তার হাতে থাকে ছুরি দিয়ে ওই যুবককে আঘাত করেলে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এরপরও ক্ষ্যান্ত হয়নি রাহাত। লুটিয়ে পড়া যুবকের উপর চড়াও হয়ে এস এস পাইপ দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করে।
পরে স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসী রাহান দৌড়ে পালিয়ে যায়। এই ঘটনায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘নারায়ণগঞ্জ টাইম’সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদের সূত্র ধরে শনিবার (১ জুন) দুপুরে সাংবাদিক মোস্তাক আহমেদকে দেশের বাইরে থেকে মোবাইলে হুমকি দেয় দুই কিশোরগ্যাংয়ের শেল্টারদাতা শফিকুল ইসলাম শফি। এ ঘটনায় মোস্তাক আহমেদ রোববার (২ জুন) শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় জিডি করেছেন।
জিডিতে সাংবাদিক মোস্তাক উল্লেখ করেন, “সিদ্ধিরগঞ্জে টেনশন গ্রুপের সদস্য রাহাতের হামলায় যুবক আহত, মোটরসাইকেল ভাংচুর” এই শিরোনামে নারায়ণগঞ্জ টাইমস নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত একটি সংবাদের জের ধরে তার ব্যবহৃত ওয়াটসঅ্যাপস নাম্বার (০১৯২ ৩৭২৭৩৪৭) এ শনিবার (১ জুন) দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে ফোন করে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে উক্ত শিরোনামের সংবাদটি নিউজ পোর্টাল থেকে নামিয়ে ফেলার জন্য বলেন শফিকুল ইসলাম শফি তার ব্যবহৃত ওয়াটসঅ্যাপস নাম্বার (০১৯৪১ ৪২০৫৫৫) থেকে।
এর কারণ জানতে চাইলে শফি বলেন, সংবাদে মিজমিজি কবরস্থানের পাশে এটি মাছের খামারের মাছ ধরে নিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এক যুবককে তার ছেলে সীমান্ত মারধর করেছে উল্লেখ করা হয়েছে। যাহা সঠিক নয়, মিথ্যা। কারণ তিনি ও তার ছেলে ভারতে অবস্থান করছেন।
এর উত্তরে মোস্তাক আহমেদ শফিকুল ইসলামকে বলেন, সংবাদের কোথাও উল্লেখ নেই সীমান্ত মারধর করেছে। প্রয়োজনের সম্পাদকের সাথে কথা বলুন। এরপরই শফিকুল ইসলাম উত্তেজিত হয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেন, দেশে ফিরে এসে মোস্তাক আহমেদকে দেখে নিবেন। চাঁঁদাবাজিসহ বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিবেন। এরপরই ফোনের লাইন কেটে দেন।
সাংবাদিক মোস্তাক জানান, এ ঘটনায় আমার ধারণা শফিকুল ইসলাম ও তার দুই ছেলে টেনশন গ্রুপের লিডার রাইসুল ইসলাম সীমান্ত ও অপর ছেলে ডেবিল এক্সো গ্রুপের লিডার মো. সারিব আমাকে বিভিন্নভাবে হয়রানিসহ ভবিষ্যতে বড় ধরণের ক্ষতি করতে পারে। এই দুই গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা।
তাদের বিরুদ্ধে ইভটিজিং থেকে শুরু করে মাদক বিক্রি, মাদক সেবন, চুরি, ছিনতাই, অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকান্ডে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও একাধিক অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে আমি সড়ক দূর্ঘটনায় বাম পায়ে গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘ ৮ মাস যাবত বাসায় অবস্থান করছি। অসুস্থতা ও পরিবার পরিজনদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও পরামর্শ করে সাধারণ ডায়েরীর আবেদন করতে বিলম্ব হয়েছে।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, সিদ্ধিরগঞ্জে ২নং ওয়ার্ডে আতঙ্কের নাম কিশোরগ্যাং সন্ত্রাসী ‘টেনশন গ্রুপ’ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপ’। তাদের নানা অপকর্ম নিয়ে অসংখ্য সংবাদ প্রকাশিত হয় স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে। কিন্তু বার বারই বাহিনীর সদস্যরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়।
কারণ দুই বাহিনীর শেল্টারে রয়েছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শফিকুল ইসলাম শফি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করার জন্য শফিকুল ইসলাম তার দুই ছেলে সীমান্ত ও সারিবকে দিয়ে কিশোরী গ্যাং সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে দুটি বাহিনী গঠন করে।
কিন্তু এই দুই বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী শফিকুল ইসলামকে ভোট দেয়নি। ফলে নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে শফিকুলের।
এদিকে ‘টেনশন গ্রুপ’ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপ’ এর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে চলতি বছরের ২৪ মার্চ দুই বাহিনীর প্রধান সীমান্ত ও সারিবসহ ১৭ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১।
ওই সময় র্যাব-১১ এর উপ-পরিচালক মেজর সানরিয়া চৌধুরী জানান, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা রাস্তায় চলাচলরত জনগণের মালামাল ছিনতাই, বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মালবাহী ও যাত্রীবাহী পরিবহনে নিয়মিতভাবে ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে থাকে।
আসামিরা বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পরিকল্পিতভাবে দলবদ্ধ হয়ে শক্তির মহড়া বা দাপট প্রদর্শন করে জনমনে ভয়ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি করে। এলাকাবাসী তাদের হিংস্রতা, অত্যাচার ও নির্যাতনের ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না।
তিনি আরও জানান, টেনশন গ্রপ-এর দলনেতা রাইসুল ইসলাম সীমান্ত ও সদস্য মো. প্রিতম রোবায়েতি ইসফাক এবং ডেভিল এক্সো গ্রুপ-এর সদস্য মো. আশিক এবং মো. নাঈমের বিরুদ্ধে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় হত্যা, ধর্ষণসহ একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন র্যাবের এই কর্মকর্তা।
এরআগে ২০২২ সালের ৬ আগসস্ট টেনশন গ্রুপের লিডার সীমান্ত ও তার বাহিনীর ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১১। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি গুপ্তি ছোরা, দুইটি গিয়ার সুইচযুক্ত ধাঁরালো চাকু, দুইটি ছোরা ও একটি ষ্টিলের পাইপ।
আরও পড়ুন: সিদ্ধিরগঞ্জে টেনশন গ্রুপ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপের ১৭ সদস্য গ্রেপ্তার
এলাকাবাসী বলছেন, ‘টেনশন গ্রুপ’ ও ডেভিল এক্সো গ্রুপ’কে থামাতে হলে তাদের শেল্টারদাতা শফিকুল ইসলাম শফিকে আইনের আওতায় আনতে হবে আগে। কারণ তার পৃষ্ঠপোষকতায় এই দুই বাহিনী বীরদর্পে অপকর্ম করে যাচ্ছে। এই জন্য জেলা পুলিশ সুপার ও র্যাব-১১ এর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।