নারায়ণগঞ্জ টাইমস | Narayanganj Times

বুধবার,

১৫ জানুয়ারি ২০২৫

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গুনধর ওসি গোলাম মোস্তফা এখন বন্দরে

নারায়ণগঞ্জ টাইমস:

প্রকাশিত:২২:১৭, ১০ ডিসেম্বর ২০২৩

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার গুনধর ওসি গোলাম মোস্তফা এখন বন্দরে

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আলোচিত-সমালোচিত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফা বদলী হয়েছেন। তবে তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাড়তে হয়নি। নদীর পশ্চিম  পাড় থেকে পূর্বপাড়ে বন্দর থানায় পদায়ন হয়েছেন চতুর এই ওসি। 


বিভিন্ন তথ্যমতে, ওসি গোলাম মোস্তফা বদলী হওয়ার কয়েকদিন আগেই জেনেছেন তার বদলীর অর্ডার হয়েছে। তাই দেনদরবার করে বন্দর থানায় গিয়েছেন তিনি। রোববার (১০ ডিসেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে বিদায় নিয়েছেন সামারীবাজ ওসি হিসেবে পরিচিত গোলাম মোস্তফা। এরআগে শনিবার (৯ ডিসেম্বর) রাতে থানায় বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীসহ অনেককে ডেকে এনে বিদায় পুর্ব শেষ করেছেন। তবে বিদায় ঘন্টা বাজলেও মাসিক মাসাহোরা কালেকশন করতে ভুলেননি তিনি। কারণ মাসের ১০ তারিখের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জের চোরাই তেল ব্যবসায়ি, ভুমিদস্যু, পরিবহন সিন্ডিকেট, রেন্ট এ কার, বালু ও পাথর ব্যবসাসহ বিভিন্ন খাত ছিল তার অবৈধ আয়ের উৎস। এছাড়া নিয়মিত ছিল আটক বাণিজ্য।


মজার বিষয় হলো সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়িত্বপালনকালে বড় ধরনের মাদক বিরোধী অভিযান তিনি করছেন বলে জানেন না এলাকার মানুষ। তবে মাঝে-মধ্যে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আসার জন্য বা চাপে পড়ে কিছু কিছু সময়ে থানার দারোগাদের দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে মাদক উদ্ধার করেছেন।


কদমতলী উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ওসি গোলাম মোস্তফার সরাসরি শেল্টারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সন্ত্রাসী তানজিম কবির সজু। বেশ কয়েকটি মামলার আসামী হওয়ার পরও তাকে প্রথমে শেল্টার দেয়া শুরু করে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) হাফিজুর রহমান। তার বদলী হওয়ার পর বর্তমানে ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মোজাম্মেল শেল্টার দেয়। পরে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সজুর। ফলে ইন্সপেক্টর মোজাম্মেল এবং ওসি গোলাম মোস্তফার শেল্টায় পায় সন্ত্রাসী সজু। সন্ত্রাসী সজুর সঙ্গে কোটি টাকা মূল্যের একটি জমি নিয়ে বিরোধ শুরু হয় টুটুল নামে আরেক ভুমিদস্যুর। এই ভুমিদুস্য ও সন্ত্রাসীকে একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টা পাল্টি মামলা করার ইন্দন যুগিয়ে দুইজনের কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়েছে ওসি গোলাম মোস্তফা। ফলে পাল্টা পাল্টি মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার হতে হয়নি। এক পর্যায়ে ২৬ অক্টোবর র‌্যাব-১১ এর একটি টিমের হাতে অস্ত্র ও মাদক সহ গ্রেপ্তার হয় সন্ত্রাসী সজু। পরে সজু বাহিনীর কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে টুটুলকে ১৭ নভেম্বর এস আই কামরুল হাসানকে দিয়ে আটক করায় ওসি গোলাম মোস্তফা। এবং নাশকতার একটি মামলায় টুটুলকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। অথচ গ্রেপ্তারের আগে দুই সন্ত্রাসীকে পৃথক পৃথকভাবে ওসি গোলাম মোস্তাফার সাথে সখ্যতা দেখা গেছে।


আদমজী নতুন বাজার, সোনামিয়া বাজার, আইলপাড়া এলাকার বেশ কয়েকজন অধিবাসী অভিযোগ করে বলেন, আদমজী বিহারী ক্যাম্প মাদক বিক্রির অন্যতম স্পট। ক্যাম্পের ভেতর অর্ধ শতাধিক ব্যদক ব্যবসায়ি সক্রীয়। প্রকাশ্যে তারা মাদক দ্রব্য বিক্রি করলেও ওসি গোলাম মোস্তফা কোন কর্ণপাত করেননি। অথচ থানার পেছনে মাত্র কয়েক শত গজের মধ্যে বিহারী ক্যাম্পের অবস্থান। ক্যাম্পের একাধিক মাদক ব্যবসায়ি হচ্ছে পুলিশের সোর্স। ফলে ওসি গোলাম মোস্তফার বদলীতে বিহারী ক্যাম্পের মাদক ব্যবসায়িদের মন খারাপ হলেও খুশি হয়েছেন এলাকাবাসী। 


তারা আরও বলেন, সিদ্ধিরগঞ্জের ১০টি ওয়ার্ডে কমপক্ষে অর্ধ শতাধিক মাদকের স্পট রয়েছে। দিন-রাত মাদক বিক্রি হলেও স্থানীয় প্রশাসনের ভুমিকা রহস্যজনক। ওসি গোলাম মোস্তফা এ বিষয়ে কার্যকরী কোন প্রদক্ষেপ নিয়েছে বলে আমাদের চোখে পড়েনি। 


ওদিকে অবৈধ ব্যবসায়িদের একাধিক সূত্রমতে, সিদ্ধিরগঞ্জে বার্মাইষ্টার্ণ, এসওরোডসহ বিভিন্ন এলাকার চোরাই জ্বালানী তেল ব্যবসায়ি, সিদ্ধিরগঞ্জে চিটাগাংরোড রেন্ট-এ কার স্ট্যান্ড, চিটাগাংরোড থেকে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহন, ভুমিদস্যু, বালু ও পাথর বাবসায়িদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন ওসি গোলাম মোস্তফা। প্রশাসনের গোয়েন্দা সংস্থার সঠিক তদন্ত করলে ওসি গোলাম মোস্তফার নানা অবৈধ আয়ের চিত্র বেরিয়ে আসবে বলেও মত দিয়েছেন কেউ কেউ। তবে আবার দুই একজন জানিয়েছেন, পত্রিকায় লিখে লাভ নাই। অবৈধ ব্যবসায়িদের ম্যানেজ করে ওসি তার পক্ষে সাফাই সাক্ষী নিয়ে নিবে। আবার সাংবাদিক নামধারী কতিপয় সোর্স এর সঙ্গেও ওসি গোলাম মোস্তফার দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল। তাই ওই নামধারীরাও ওসির অপকর্মের সাফাই গাইবে। এই সোর্সদের বিরুদ্ধেও মাদক ব্যবসায়িদের শেল্টার দেয়া ও মাদক ব্যবায়িদের কাছ থেকে মাসোহারা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। 


ওদিকে সব মিলিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুলিশ ইচ্ছে করলেই সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়িদের দমন করতে পারে। কিন্তু সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশ সেই উদ্যোগ নেয়নি। বরং সাধারণ মানুষ যখন দেখে অপরাধীরা পুলিশের সাথে ঘুরে বেড়ায়, থানায় গিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত ওসির রুমে আড্ডা দেয়। তখন আর কিছু বলার সাহস পায় না তারা। 


সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ওসি গোলাম মোস্তফার শুরুটা যেমন ছিল
২০২২ সালের ১১ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন গোলাম মোস্তফা। যোগদানের এক সপ্তাহের মাথায় তার বিতর্কিত এক ঘটনা নানা প্রশ্নের সৃষ্টি করে সচেতন মানুষের মধ্যে। আদালতের নির্দেশ ছাড়াই আর্থিক সুবিধা পেয়ে মাদকসহ র‌্যাবের হাতের আটক হওয়া একটি ট্রাকের মালামাল ও সড়ক দুর্ঘটনায় জব্দ করা ট্যাংকলরির তেল দিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের বেঙ্গল গ্রুপের পণ্যবাহী একটি ট্রাক (চট্ট মেট্রো-ট-১১-৫৪৩১) ৩৫ কেজি গাঁজাসহ আটক করে ১৯ জানুয়ারি সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন র‌্যাব-৩। আদালতের নির্দেশ ছাড়াই আর্থিক সুবিধা পেয়ে ওসি গোলাম মোস্তফা ওই ট্রাকের মালামাল দিয়ে দেন। এছাড়াও ১৩ জানুয়ারি সকালে সাইলো এলাকায় তেলবাহী ট্যাংকলরি (পিরোজপুর ট-৪১-০০৭০) ও ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষে তিনজন গুরুতর আহত হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ ট্যাংকলরিটি জব্দ করেন। ওই ট্যাংকলরিতে থাকা তেলও তিনি দিয়ে দেন মাসোহারা নিয়ে।


তাছাড়া ১৩ জানুয়ারি রাতে আমেরিকা প্রবাসী এক সাংবাদিকের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকার মালামাল লুট করে নেয় ডাকাতরা। এ ঘটনায় মামলা হলেও অদ্যবধি পর্যন্ত কাউকে আটক বা লুন্টিত মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। একইদিন ১৩ জানুয়ারি দিন দুপুরে রহিম মেম্বারের বাড়ীর দ্বিতীয় তলায় আব্দুল কুদ্দুছের বাসা থেকে নগদ ৩৩ হাজার টাকা ও দুই ভরি স্বর্ণালংকার চুরি, ১৬ তারিখ মিজমিজি বাতানপাড়া ক্যানেলপাড় প্রবাসী মাজেদুলের বাড়ী থেকে একটি ল্যাপটপ ও একটি টার্চ মোবাইল চুরি, ১৮ জানুয়ারি মিজমিজি কান্দাপাড়া শফিকুল ইসলামের বাড়ী থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল চুরি হয়। ১৮ জানুয়ারি বিকেলে জালকুড়িতে ঘটে খুনের ঘটনা। এই ছিল গুনধর ওসি গোলাম মোস্তফার সিদ্ধিরগঞ্জে যোগদানের মাত্র ১১দিনের ঘটনা। ২৩ মাস তার দায়িত্ব পালনের সময়ের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার চিত্র তুলে ধরলে দিন পার হয়ে যাবে। অথচ গুনধর সেই ওসি গোলাম মোস্তফার জেলার বাইরে বদলী না হয়ে একই জেলা তাও আবার নদীর ওপাড়ের থানায় পদায়ন হওয়ায় বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সিদ্ধিরগঞ্জের সচেতন মানুষ।
 

সম্পর্কিত বিষয়: