চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতি নিতে গাড়ি থামালাম কুমিল্লার একটি সাধারণ খাবার হোটেলে। হোটেলের নাম ‘উড়াধুড়া খাবার হোটেল’৷ তীব্র শীতে নিজেকে স্যাতস্যাঁতে কোন জায়গার ছত্রাক মনে হচ্ছে। কোনরকম হাত মুখ ধুঁয়ে খেতে বসেছি। কিশোর বয়সের এক হাসিমাখা চেহারার ছেলে আসলো। কাঁধে রাখা গামছা দিয়ে টেবিল মুছে দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে, – ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে….’ আমি নাম জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর নাম কিরে পুচকে?’ কিশোরটি লাজুক হাসি দিলো৷ যেন আমি ওকে লজ্জায় ফেলে দিলাম৷ বললো, ‘ আমার নাম বাদশা।’ আমি হো হো করে হেসে দিলাম। চারপাশের মানুষগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিলো। আমি বাদশাকে বললাম, – তোর বাবা মা কই থাকে? – আমার লগেই। – তোর ভাইবোন কয়জন? – আমি একলাই৷ – তোর নাম জিজ্ঞেস করাতে লজ্জা পাইলি কেন? – করি মেসিয়ারির কাম! আর নাম রাখছে বাদশা। তাই নাম বলতে লজ্জা লাগে। – দূর বেক্কল! তুই তো বাদশাই। তুই তোর মায়ের কাছে বাদশা। তোর বাবার কাছে বাদশা। আমিও বাদশা। আমি আমার মায়ের কাছে বাদশা, আমার বাবার কাছে বাদশা৷ বাদশা আবার হাসলো। তবে এবারের হাসিটা কৃত্রিম।
পরোক্ষনেই জিজ্ঞেস করলো, – আপনি কি খাইবেন মামা? – কি কি আছে? বাদশা একদমে হোটেলের সব খাবারের নাম বললো। আমি ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি। বাদশা খাবারের নাম বলছে আর আমার মনে হচ্ছে ও আমাকে কবিতা শুনাচ্ছে। যেমনটা আমার ভাগ্নে ভাগ্নি শুনায়। সাধারণ মানের হোটেল হলেও খাবারের মান ভালো৷ বাদশা কিছুক্ষণ পরপর এসেই আর কিছু লাগবে কি না জিজ্ঞেস করছে৷ খাওয়া শেষে হাত ধোঁয়ার জন্য বেসিনে গেলাম। হঠাৎ উচ্চস্বরে বকাঝকার শব্দ শুনে বেসিনের আয়নায় তাকালাম। বাদশাকে অশ্রাব্য ভাষায় বকছে হোটেল মালিক৷ বাদশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্রুত হাত ধুয়ে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাড়ালাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বাদশাকে জিজ্ঞেস করলাম, – কত হয়েছেরে আমার বিল? – দেশশো টেহা৷ ( দেড়শো টাকা) আমি টাকা দিতে দিতে মাহাজনকে জিজ্ঞেস করলাম, – বাদশাকে বকছেন কেন? হোটেল মাহাজন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, – আরে ভাই আর বইলেন না! হাতেম তাই সাঝে। নিজেই খাইতে পারে না আবার রাস্তার পোলাপান নিয়া আহে খাওয়ানোর জন্য। বাদশার চোখ ছলছল করছে। আমি বাদশার দিকে তাকিয়ে বললাম, – কি হইছে তুই বল তো শুনি।
বাদশা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, – রাত হইলেই হোটেলের সামনে পোলাপান আইসা ভিড় জমায়। ক্ষিদার জ্বালায় ছটফট করে। আমার এগুলা দেখলে কষ্ট লাগে। তাই আমি রাতে ডিউটি করলেই একটারে আইনা খাওয়াই৷ মাহাজন আবার হুংকার দিয়ে বললো, – তোর বাপের হোটেলরে শালা! যারে তারে আইন্যা খাওয়াবি? এবার বাদশা ক্ষেপে গিয়ে বললো, – আপনি চাকরি দেওয়ার আগে কইছেন খাওয়া দাওয়া হোটেলে করতে। আমার রাইতে ডিউটি করলে ক্ষিধা লাগে না। তাই আমার খাওন ওগো খাওয়াই। আপনের সমস্যা কি! হোটেল মাহাজন ক্ষিপ্ত কণ্ঠে আমাকে বললো, – দেখছেন, দেখছেন? ফহিন্নির পুতে কত্ত বেয়াদপ! মুখে মুখে তর্ক করে! বাদশা এবার আরো ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো, – আপনের চাকরি আমি করতাম না। আমারে হোটেলে নেওয়ার লেগা অন্য মাহাজনরা পাগল হইয়া রইছে।
বাদশার এই ক্ষিপ্রতা দেখে মাহাজন এর সুর নরম হলো। গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বললো, – যা টেবিল পরিষ্কার কর গিয়া। বাদশাও কথা না বাড়িয়ে কাজে মন দিলো। আমি বাদশার দিকে তাকিয়ে আছি। বাদশাকে ডাক দিয়ে বললাম, – দুই কাপ চা দে তো। বাদশা মুহুর্তের মধ্যেই দুই কাপ চা নিয়ে হাজির। আমি বাদশাকে ইশারায় বসতে বললাম। বাদশা আমার পাশে বসে বললো, – আপনার অনেক চায়ের নেশা, না? – না৷ এক কাপ তোর জন্য৷ দুইজন মিলে খাবো। নে চুমুক দে৷ আমি একটি কাপ ওর দিকে এগিয়ে দিলাম। খুব করে ইচ্ছে করলো, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। চায়ের কাপটি টেবিলে রেখে ওর বাদামি রঙের এলোমেলো চুলগুলো হাত দিয়ে একপাশে করে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, – পড়াশোনা করিস নাই? বাদশা জিহবা কেটে বললো, – ফোর পর্যন্ত পড়ছি। আমি বললাম, – আমার একটা অনুরোধ রাখবি? – কি? – একটা কবিতা শুনাবি আমাকে? – কি কবিতা শুনবেন? – তুই যেটা পারিস।
বাদশা কিছুক্ষণ ভেবে কবিতা বলতে শুরু করলো, ‘ সবার সুখে হাসবো আমি, কাঁদবো সবার দুঃখে, নিজের খাবার বিলিয়ে দিবো অনাহারীর মুখে।’ – ভাই আপনি কান্দেন ক্যান? বাদশার কথায় আমার ঘোর কাটলো। হাত দিয়ে চোখের জল মুছে উঠে দাড়ালাম। বাদশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, – ভালো থাকিস বাদশা। তোর রত্নগর্ভা মা’কে আমার সালাম দিস। ‘সমাপ্ত’