এই যে বেঁচে আছি স্রোতের পরেও, এটাই তো পরম পাওয়া। মাঝে মাঝে গ্রিলে আটকানো জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠি মনে হয়; জীবনের খাঁচা ভেঙেচুরে মুক্তির জন্য বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু বেরিয়ে গেলেই কি মুক্তি মিলবে? মুক্তি কিসে?
জীবনের ধেয়ে চলা স্রোতে, সংগ্রামে, মেতে ওঠা রঙ্গমঞ্চে নাকি আত্মতৃপ্তিতে? নাকি স্রষ্টার মূল উদ্দেশ্য চরিতার্থে? পৃথিবীর অসুখ মানুষকে নামিয়ে এনেছে একই কাঁতারে, যেখানে বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই ভোগে অনিশ্চয়তায়। কয়েক দিন আগেও কি কেউ কল্পনায় রেখেছিল এতটা নিষ্ঠুর পৃথিবীর রূপকে!
এই সংকট মানুষে মানুষের হৃদ্যতা সৌহার্দ্য যেমন প্রমাণ করেছে, তেমনি প্রমাণ করেছে মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব কিংবা দৌরাত্ম্যও। যে স্বামী, বাবা, কর্তারা নিজেদের সর্বস্ব ভুলে পরিবারে দু’টাকা বাড়তি আয়ের জন্য, সন্তানদের আবদার রাখার জন্য, পাশের বাসার ভাবিকে দেখে স্ত্রীর গহণা কিংবা প্রতিযোগিতায় প্রথম কাঁতারে থাকার সব উপাদান যোগানে বৈধ- অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছিল, দেশ, মাটি ও মানুষের কাছ থেকে সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, আজ সেই স্ত্রী সন্তান কোথায় তাদের?
মাঝে মাঝে নিজেকে মনে হয় খিঁলগাওয়ের মৃত্যুর দাফনে থাকা লাশ। আমি আহাজারি করছি, অথচ কেউই আমায় সাড়া দিচ্ছে না! আমার দিকে একটু তাকাচ্ছেও না। আমার কবরে একটু মাটির জন্য পৃথিবীজুড়ে হাহাকার আজ কোন শূন্যতায় মিলিয়ে গেলো?
মাঝেমধ্যে নিজেকে মনে হয় প্রথিতযশা কোনো একজন। যেই আমি জীবনকে ছাঁপায়-ছাপিয়ে, উঁচুতে কিংবা আওড়াতে ব্যস্ত ছিলাম, ব্যস্ত ছিলাম ম্যাগাজিনের ফিচার, কলাম কিংবা হরেকরকম গল্পে। ক্লান্ত হয়ে ঘেমে পড়া লোকেরাও ব্যস্ত ছিল আমার অটোগ্রাফের জন্য। এই আমি আজ কোথায় মিলিয়ে গেলাম!
আমার ঠাঁই মিললো বেওয়ারিশ লাশের ওয়ার্ডে। আমায় দাফন করলো অজ্ঞাত লোকেরা কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কোনো এক বালক, যার পরিবার আমার পরিবারের মতো টাকার পাহাড় না গড়তে পারলেও মনুষ্যত্ব গড়তে সফল হয়েছে।
কিংবা নিজেকে মনে হয় স্যার স্যার করে ভয়ে কাতর করে রাখা কোনো একজন, যার ব্যবহারে থাকতো আমলাতন্ত্রের সুযোগ কিংবা ক্ষমতার প্রদর্শন।
আমার Rat race এ ছুটে চলা জীবন আজ নিস্তব্ধতায় বাসা বেঁধেছে। নিথর অসারে পড়ে আছে। মুহূর্তে আমার বন্ধু-স্বজন আমার কাছের কেউ আসবে কি? আমার অসহায়ত্বে আফসোস করতে করতে ফেলে আসা কর্মে কোনো কিছু নিয়ে ভাবার ফুরসত পাবো কি?
আমার ভাবনার ঘোরে জীবনের কাছাকাছি হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। জেগে দেখি না আমার প্রাণবায়ু এখনো সজীব! ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের একটা সুবিধা আছে। ইচ্ছে হলেই নতুন করে আবার জেগে উঠে নিজেকে নতুন করে সাজানো যায়। গুছিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু সত্যিকারের ঘুম যেদিন আমায় স্পর্শ করবে, আমার আয়ু ফুরিয়ে গেলে, ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত কাজে রাস্তায় ঢলে পড়লে, মরনের ডাকে সাড়া দেওয়ার আগে লেনদেনের সব হিসেব চুকিয়ে নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে স্রষ্টার সান্নিধ্যে ধরা দিতে পারব তো?
বসন্তের কোকিলের সুর, শরতের সকাল, সরিষের হরিদ্রাব কিংবা সবুজের পাড়ি ধেয়ে চলা মাঠ ঠিকই থাকবে। থাকবে আমার তিলতিল করে গড়ে ওঠা অট্টালিকা বসত বাড়ি সব আগের মতোই। থাকবে পৌষের শীতের সকালের আসর জমানো প্রজন্মের পিঠার আসর কিংবা মাতবে চাঁদনী পসরা রাতের আড্ডাগুলোও। থাকবো না শুধু আমি।
কেউ কি তখন আমায় মনে করবে? কথার ফাঁকে মনে পড়লেও আমার জন্য অনুভূতির দু’ফোঁটা পানি না ফেলে আমায় কি তার মোনাজাতে রাখবে?
লেখক: শিক্ষার্থী, রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগ (৩য় বর্ষ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।